রাস্তায় সেদিন জ্যাম-এ আটকে আছি। এমন সময় একজন এসে বললেন, ‘আপা আমাকে কিছু টাকা দিন।’ আমি তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। দেখলাম, বেশভূষা মেয়ের কিন্তু চেহারা পুরুষালী। তাঁকে টাকা দিলাম। তিনি তা নিয়ে চোখের পলকে মেয়েদের মত করে হেটে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে উঠে গেলেন। দেখলাম, সেখানে আরো কজন তারই মতো। দলবেধে কথা বলতে বলতে তারা চলে গেলেন সেখান থেকে।
তাদের অঙ্গভঙ্গি রাস্তায় অপেক্ষমান অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিলো। দু’একজন বলেও ফেললেন হিজড়া। এই ধরণের মানুষ যারা পুরুষও না, নারীও না তারা তৃতীয় লিঙ্গ। সমাজে তাদেরকে বলা হয় হিজড়া। খেয়াল করলে দেখা যায়, অনেকেই অবজ্ঞার্থে এদেরকে হিজড়া বলে থাকেন। দেশের অনেক স্থানে এদের বলা হয় ‘ছক্কা’। কিন্তু এই মানুষদের পরিচয় অন্যভাবেও আছে। যেমন, বৃহন্নলা, শিখন্ডী, নপুংসক, ক্লীবলিঙ্গ, উভলিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার, কমনজেন্ডার, ইন্টারজেন্ডার বা হারমাফ্রোডাইট।
এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বড় অসহায় আমাদের সমাজে। এমন নয় যে, শুধু অনুন্নত দেশগুলোতেই তাঁরা অসহায় বরং উন্নত দেশগুলোতেও তাদের অবস্থা একই। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পৃথিবীর সর্বত্র অচ্ছুত্ হিসেবে পরিগণিত। অথচ নারী এবং পুরুষ যেমন এই প্রকৃতির সৃষ্টি তেমনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও এই প্রকৃতিরই সৃষ্টি। এটা অস্বীকার করার উপায় আমাদের নেই। একই প্রকৃতিতে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা আজ সমাজের সর্বত্র অবহেলিত। তাদের একটি আলাদা সমাজ গড়ে উঠেছে। প্রচলিত এই সমাজের অংশ হিসেবে তাদের ভাবা হয় না বিধায় তারা প্রায় একঘরে জীবন যাপন করে থাকেন।
সমাজের কোন ক্ষেত্রেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যেনো জায়গা নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে বা চাকরি ক্ষেত্রে তারা অবহেলিত, সর্বত্রই তাদের জন্য অপেক্ষা করে ‘না’ শব্দ। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা যৌন কর্মে জড়িয়ে পরেন। কিছু সংখ্যক মানুষ ভিক্ষা বৃত্তিতে জড়িয়ে পরেন। এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ আছে যে, তারা রাস্তায় প্রায় সময় পথচারীদের হেনস্তা করেন অর্থের জন্য। টাকা না দিলে অনেক সময় তারা পথচারীদের মারধর করেন, আজেবাজে কথা বলেন এমনকি মানসম্মানে হাত দেন।
গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় যে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা নূন্যতম সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত। তাঁরা কোন কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না। তারা এত অবজ্ঞা ও অবহেলা পেয়ে থাকেন যে, শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের হিজরা বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু কখন একজন মানুষকে তৃতীয় লিঙ্গ বলা হয় এবং তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ার পেছনে কারণ কী?
যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, সে ক্ষেত্রে কয়েকটি লক্ষণ দেখতে পেলে তাকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সনাক্ত করা হয়। যেমন :
১) শিশুর দেহে শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয় উভয়ই উপস্থিত থাকলে।
২) শিশুর দেহাকৃতি মেয়েদের মত কিন্তু স্ত্রী জননাঙ্গের পরিবর্তে পুং জননাঙ্গ উপস্থিত থাকলে।
৩) শিশুর দেহাকৃতি ছেলেদের মত কিন্তু তার জননাঙ্গ অপূর্ণ থাকলে।
শিশুর জন্মের পরই যদি এই ব্যপারটা তার বাবা মা ধরতে পারেন আর চিকিত্সার ব্যবস্থা নেন তবে এই শিশুটি শিশুকালেই তার এই শারীরিক ত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারে আর ভবিষ্যতের অসম্ভব কষ্ট থেকে রেহাই পেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শিশু বয়সে এই ত্রুটি খুব কম বাবা মা’ই ধরতে পারেন। যখন ধরতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে যায় যা চিকিত্সার বাইরে চলে যায়।
একটি শিশু কেন পুরুষ বা নারী হয়ে জন্ম না নিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্ম নেয়? মায়ের গর্ভে শিশুর কোষের নিউক্লিয়াসে যদি দুটি সেক্স ক্রোমোজোম ঠিক এভাবে XX থাকে তবে শিশুটি নারী হিসেবে জন্ম নেয়। আবার যদি দুটি সেক্স ক্রোমোজোম ঠিক এভাবে XY থাকে তবে শিশুটি পুরুষ হিসেবে জন্ম নেয়। এখন মায়ের গর্ভে শিশুর কোষের নিউক্লিয়াসে যদি দুটি সেক্স ক্রোমোজোম না থেকে তিনটি থাকে আর ঠিক এভাবে থাকে XXY বা এভাবে XYY থাকে তখন শিশুটি নারী বা পুরুষ হিসেবে জন্ম না নিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্ম নেয়।
হিজড়া মানেই কিন্তু একটা সমস্যা নয়। চিকিত্সা বিজ্ঞানের যে উন্নতি হয়েছে তাতে চিকিত্সার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান আজ অনেকখানি সহজ হয়ে এসেছে। শিশুর জন্মের পর যদি বোঝা যায় শিশুটির এ ধরনের সমস্যা আছে তাহলে চিকিত্সক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ (ছেলে না মেয়ে) নির্ধারণ করেন এবং শিশু হরমোনজনিত চিকিত্সার মাধ্যমে তা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমেও এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। সঠিক চিকিত্সা দ্বারা হিজড়া শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় স্বাভাবিক জীবন পেতে পারেন।
সূত্র:নেফারতিতি চৌধুরী/risingbd.com
You must be logged in to post a comment.