সাম্প্রতিক....
Home / জাতীয় / তিনি আছেন ‘পরানের গহীন ভিতর’

তিনি আছেন ‘পরানের গহীন ভিতর’

sayed-shamsul-hoque

রফিক মুয়াজ্জিন :

‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর/মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর… এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।’

তিনি ছিলেন কবিতার বড় বাজিকর। সাহিত্যমোদীদের পরাণের গহীন ভেতরে তিনি কবিতার রুমাল নেড়েছেন। বলছি সৈয়দ শামসুল হকের কথা।

শুধু কবিতার কথা বলছি কেন? কাব্যনাট্য, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ- সাহিত্যের কোন অঙ্গনে তার পদচারণা ছিল না? পাঠক-সমালোচক তাকে ‘সব্যসাচী’ লেখক বলেন। সব্যসাচী মানে যিনি দুই হাতেই সমান পারদর্শী। সাহিত্যের ক্ষেত্রে যিনি বিভিন্ন শাখায় সমান স্বচ্ছন্দ- তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়।

সৈয়দ শামসুল হকের সৃষ্টির দিকে যদি তাকাই, দেখি, বিপুল সম্পদ তিনি রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরানের গহীন ভিতর (১৯৮০), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮), বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯), কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), তোরাপের ভাই (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১), নাভিমূলে ভস্মাধার, কবিতা সংগ্রহ, প্রেমের কবিতা, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯), তরঙ্গের অস্থির নৌকায় (২০১৫)।

বাংলা ভাষায় অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু কবিতায় আলাদা স্বর আছে ক’জনের? শিরোনাম আর কবির নাম ছাড়া কোনো কবিতা যদি পাঠ করি, অনেক কবিতার লেখককে হয়ত আমরা চিহ্নিত করতে পারব না। তবে কিছু কিছু কবিতা পড়লে বোঝা যায়, এগুলো সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা। স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়নে বিশেষত্ব আছে বলেই সৈয়দ শামসুল হককে আলাদা করা যায়। বাক্যালঙ্কার আর শব্দালঙ্কারের ব্যবহারেও তার বিশেষত্ব টের পাওয়া যায়। কিছু অপ্রচলিত ও আঞ্চলিক শব্দকে যথাযথ মর্যাদায় কবিতায় স্থান দিয়েছেন তিনি-

‘আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?

মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?

এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?

সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?’

সৈয়দ শামসুল হকের বিরুদ্ধে অবশ্য অভিযোগও আছে- তিনি কিছু আঞ্চলিক শব্দ বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন। তবে অনেকেই তার এই শব্দচয়ন সাদরে গ্রহণ করেছেন।

‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,

ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,

ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?

অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।’

বাংলা সাহিত্যে কাব্যনাট্যে অনন্য অবদান সৈয়দ শামসুল হকের। সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক সফল কাব্যনাট্যের রচয়িতা তিনি। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘এখানে এখন’, ‘গণনায়ক’ প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যনাট্য। প্রথম দুটি কাব্যনাট্য বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সর্বাধিক প্রদর্শনী হওয়া নাটকগুলোর মধ্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ নাটক দুটি রয়েছে।

নূরলদীনের সারা জীবন নাটকের বিখ্যাত সংলাপ- ‘কোনঠে বাহে জাগো সবায়’ তো বহুল উচ্চারিত। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বাংলাদেশের মঞ্চে বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে।

কথাসাহিত্যেও সৈয়দ শামসুল হকের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। তার গল্প বলার ভঙ্গিও বেশ স্বতন্ত্র। তার ছোটগল্প ও উপন্যাস ভিন্ন বয়ানে গল্প বলে যায়। সৈয়দ শামসুল হকের গল্পগ্রন্থগুলো হলো- তাস (১৯৫৪), শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২), সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)।

সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসগুলো হলো- এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৮১), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড ১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলা রাম খেলে যা (১৯৯১), মেঘ ও মেশিন (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১), মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালা, কালঘর্ম, দূরত্ব, না যেয়ো না, অন্য এক আলিঙ্গন, এক মুঠো জন্মভূমি, বুকঝিম ভালোবাসা, অচেনা, আলোর জন্য, রাজার সুন্দরী প্রভৃতি।

বাংলা চলচ্চিত্রেও বিশেষ অবদান আছে সৈয়দ শামসুল হকের। অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সুতরাং’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’ উল্লেখযোগ্য।

অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা সব্যসাচী এই লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’ প্রভৃতি।

সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও হালিমা খাতুন দম্পতির আট সন্তানের প্রথম সন্তান সৈয়দ শামসুল হক। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের গর্বিত জনক সৈয়দ হক। তার স্ত্রী ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হকও লেখালেখি করেন। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি এগারো-বারো বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। টাইফয়েড জ্বরে শয্যাশায়ী থাকাকালে বাড়ির রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দুই লাইনের একটি পদ- ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে’ রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা লেখেন। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়।

সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সৈয়দ শামসুল হক। বাবার ইচ্ছা ছিল তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার এরকম দাবি এড়াতে তিনি ১৯৫১ সালে বোম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি সময় সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়।

সৈয়দ শামসুল হক আজ আর নেই। তবে এই ‘নেই’ শব্দটিকে মিথ্যে প্রমাণ করার মতো দারুণ বাজিকর তিনি। কবিতা, কাব্যনাট্য, গল্প, উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি আমাদের পরাণের গহীন ভেতরে বেঁচে থাকবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী/risingbd.com

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

রামুতে তরমুজের দাম চডা :হিমশিম খাচ্ছে ক্রেতারা

  কামাল শিশির; রামু :কক্সবাজারের রামু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পবিত্র মাহে রমজানের শুরুতে বিভিন্ন এলাকায় ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/