বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে ৯২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ী শহর বান্দরবান। বান্দরবান জেলা হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত। এর আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্যের অবারিত সবুজের সমারোহ এবং মেঘে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে যার আছে সে বাংলাদেশের পাহাড়ী কন্যা বান্দরবান ঘুরে আসতে পারেন। চলুন জেনে নেই বিস্তারিত।
দেখার মত জায়গাঃ নীলাচল, মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স, নীলগিরি, কোয়ান্টাম, স্বর্ণমন্দির, মেঘলা, শৈল প্রপাত, মিলনছড়ি, চিম্বুক, সাঙ্গু নদী, মাতামুহুরী নদী, তাজিলডং, কেওক্রাডং, জাদিপাই ঝরণা, বগালেক, প্রান্তিক লেক, ঋজুক জলপ্রপাত, নাফাখুম জলপ্রপাত, আলীকদমের আলী সূড়ং এছাড়া বান্দরবানে কয়েকটি ঝিরি রয়েছে। যেমনঃ চিংড়ি ঝিরি, পাতাং ঝিরি।
যাতায়াতঃ
ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর চট্টগ্রাম থেকে সোজা বান্দরবান; অথবা ডাইরেক্ট বান্দরবান যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে বান্দরবান সরাসরি: ঢাকা থেকে বান্দরবান পর্যন্ত ডাইরেক্ট নন এসি ভাড়া জনপ্রতিঃ ৮২০ টাকা (মার্চ,২০১৫)। এস আলম, হানিফ, ইউনিক ইত্যাদি বাস ছাড়ে ফকিরাপুল/কমলাপুর রেল ষ্টেশনের বিপরীত কাউন্টার থেকে। রেলঃ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম: ট্রেনে এসি সিট ৭৩০ টাকা, এসি বাস ১০৯০ টাকা। নন এসি- সুলভ: ২৬০/=, শোভন ৩৬৫/=, শো. চেয়ার ৪২০/=, ১ম সিট ৫৫০/=, ১ম বার্থ ৭৫৫/=, স্নিগ্ধা ৮৭০/= বাসঃ এসি- ৭০০-১২০০ টাকা। নন এসি- ৩০০-৪৫০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানঃ
বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে পূরবী এবং পূর্বাণী নামক দুটি ডাইরেক্ট নন এসি বাস আছে। ৩০ মিঃ পর পর বান্দরবানের উদ্দ্যেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতিঃ ৯০-১০০ টাকা।
কোথায় থাকবেনঃ
হোটেল ফোর স্টার : বান্দরবান সদর। সিঙ্গেল ৩০০ টাকা, ডাবল- ৬০০, ট্রিপল ৯০০ টাকা, এসি ডাবল- ১২০০ টাকা।, এসি ট্রিপল ১৫০০ টাকা। হোটেল থ্রী স্টার : এটি বান্দরবান বাস স্টপের পাশে অবস্থিত। নীলগিরির গাড়ী এই হোটেলের সামনে থেকে ছাড়া হয়। এটি ৮/১০ জন থাকতে পারে ৪ বেডের এমন একটি ফ্ল্যাট। প্রতি নন এসি ফ্ল্যাট-২৫০০ টাকা, এসি-৩০০০ টাকা। হোটেল প্লাজা বান্দরবান, সদর/হোটেল গ্রিন হিল, বান্দরবান সদর/হোটেল হিল বার্ড বান্দরবান সদর, হোটেল পূরবী বান্দরবান সদর।
নীলগিরিঃ
নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। এ পর্যটন কেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত এই পর্যটন কেনেদ্রর অবস্থান। এ পর্বতের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত উপজাতি সম্প্রদায় ম্রো পল্লী। যাদের বিচিত্র সংস্কৃতি দেখার মত। বর্ষা মৌসুমে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র থেকে মেঘ ছোয়ার দূর্লভ সুযোগ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নীলগিরি থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্থ দেখা যায়। বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র এটি। এটি সেনা তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এর পাশেই রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প। নিরিবিলিতে স্ব-পরিবারে কয়েক দিন কাটাতে এটি একটি আর্দশ জায়গা।
যাতায়াতঃ
পর্যটকদের নীলগিরি যেতে হলে বান্দরবান জেলা সদরের রুমা জীপ ষ্টেশন থেকে থানছি গামী জীপ অথবা বাসে করে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া যায়। বান্দরবান জীপ ষ্টেশন থেকে জীপ, ল্যান্ড রোভার, ল্যান্ড ক্রুজারসহ অন্যান্য হালকা গাড়ী ভাড়ায় পাওয়া যায়। নীলগিরি যাওয়ার পথে সেনা চেকপোষ্টে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। বান্দরবান জেলা সদর থেকে সাধারণত বিকেল ৫ টার পর নীলগিরির উদ্দেশে কোন গাড়ী যেতে দেয়া হয় না।
ভাড়াঃ
সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত আসা-যাওয়া-ছোট জীপঃ (৫সিট) ৩৩০০ টাকা এবং বড় জীপ (৮সিট) ৩৮০০ টাকা।
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান জেলা সদর থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায়। এ ছাড়া নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র রাত্রি যাপনের জন্য বান্দরবান সদর সেনা রিজিয়নে বুকিং দেয়া যায়। তাছাড়া নীলগিরি পর্যটনে গিয়ে সরাসরি বুকিং করা যায়। বান্দরবান জেলা সদর থেকে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় অধিকাংশ পর্যটক দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসেন।
মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্সঃ
বান্দরবান জেলার বৃহত্তর উপজেলা লামা শহর থেকে সাড়ে ৭কিঃমিঃ দূরে রিরিঞ্জা পাহাড়ে অবস্থিত পর্যটন মিরিঞ্জা। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২২শত ফুট উচ্চতায় আবস্থিত মিরিঞ্জা। পাহাড় আর মেঘের মিলনের অপরূপ দৃশ্য দেখা যাবে এখানে। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। পিকনিকের রান্না করার সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৩৩একর জায়গায় নির্মিত পর্যটন মিরিঞ্জা সহজেই সকলের মন কেড়ে নেবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া থেকে জীপ, বাস ও প্রাইভেট গাড়ীতে করে আসা যাবে। দূরত্ব ১৭ কিঃমিঃ। চকরিয়া হতে মিরিঞ্জা পর্যটনের ভাড়া ৪৫-৫০ টাকা। রাতে থাকার সুব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি থাকলে ভাল। তবে লামা শহরে মাঝারি ধরনের হোটেল রয়েছে। প্রতিরুমের ভাড়া পড়বে ৩শত থেকে ৮শত টাকা পর্যন্ত। ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস স্থল লামা যে কোন ভ্রমণ পিপাসু মানুষের মন কাঁড়বে।
স্বর্ণমন্দিরঃ
বান্দরবানের উপশহর বালাঘাটাস্থ পুল পাড়া নামক স্থানে এর অবস্থান। বান্দরবান জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ার তৈরী সুদৃশ্য এ প্যাগোডা। এটি বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান। এখানে দেশ বিদেশ থেকে অনেক বুদ্ধ ধর্মালম্বী দেখতে এবং প্রার্থনা করতে আসেন। এর অপর নাম মহাসুখ প্রার্থনা পূরক বুদ্ধধাতু চেতী। গৌতমবুদ্ধের সম-সাময়িককালে নির্মিত বিশ্বের সেরা কয়েকটি বুদ্ধ মূর্তির মধ্যে একটি এখানে রয়েছে। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এই প্যাগোডাটি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সেরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই সুউচ্চ পাহাড়ের উপর দেবতা পুকুর নামে একটি পানি সম্বলিত ছোট পুকুর আছে। এই প্যাগোডা থেকে বান্দরবানের বালাঘাটা উপশহর ও এর আশপাশের সুন্দর নৈস্বর্গিক দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া বান্দরবান রেডিও ষ্টেশন, বান্দরবান চন্দ্রঘোনা যাওয়ার আঁকা-বাঁকা পথ ও দর্শনীয়। এই প্যাগোডা একটি আধুনিক ধর্মীয় স্থাপত্যের নিদর্শন। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে এখানে মেলা বসে। এই প্যাগোডা বা জাদীটি স্বর্ণ মন্দির হিসেবেও পরিচিত। এ প্যাগোডাটি পুজারীদের জন্য সারাদিন খোলা থাকে আর ভিন্ন ধর্মাবলী দর্শণার্থীদের জন্য বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়। প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০/-। বান্দরবান শহর থেকে রিক্সা অথবা টেক্সি করে যাওয়া যায়। রিক্সা ৪০-৫৫ টাকা এবং টেক্সি রিজার্ভ ১৭০-২৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে থাকে। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত এখানে গাড়ী চলাচল করে।
মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রঃ
বান্দরবান শহরের প্রবেশদ্বার বান্দরবান কেরাণীহাট সড়কের পাশেই পার্বত্য জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স অবস্থিত। পাহাড়ের খাদে বাঁধ নির্মাণ করে কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি করা হয়েছে । বান্দরবান শহর থেকে এর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। বেড়াতে আসা পর্যটকদের চিত্ত বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে শিশুপার্ক, নৌকা ভ্রমণের সুবিধা, ঝুলন্ত সেতুর মাধ্যমে চলাচলের ব্যবস্থা এবং সাময়িক অবস্থানের জন্য একটি রেষ্টহাউস। এছাড়া আকর্ষণীয় একটি চিড়িয়াখানা এ কমপ্লেক্সের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুন। মেঘলায় ২টি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে। জনপ্রতি ২০/- মূল্যে টিকেট নিয়ে প্রবেশ করতে হবে। বান্দরবান জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হয়। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে সারা দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক বেড়াতে আসেন। নিরিবিলিতে স্ব-পরিবারে বেড়ানোর জন্য একটি আদর্শ জায়গা ।
যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়াঃ
মেঘলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের খাবার ও রাত্রিযাপনের জন্য বান্দরবান শহরে কিছু মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের জন্য খাবার ও রাত্রিযাপনের জন্য পাশেই সু-ব্যবস্থা রয়েছে। মেঘলার পাশেই রয়েছে বান্দরবান পর্যটন মোটেল ও হলিডে ইন নামে দুইটি আধুনিক মানের পর্যটন কমপ্লেক্স। এখানে এসি ও নন এসি রুমসহ রাত্রি যাপন ও উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। ফোনঃ ৬২৯১৯। বান্দরবান বাস ষ্টেশন থেকে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স যেতে লোকাল বাসে জনপ্রতি ১০-১৫ টাকা এবং টেক্সি রিজার্ভ ১০০-১২০ টাকা এবং ল্যান্ড ক্রোজার, ল্যান্ড রোভার ও চাঁদের গাড়ী ৪৫০-৫০০/- টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।
বান্দরবনে পর্যটন কর্পোরেশনের একটি হোটেল আছে মেঘলাতে। যার ভাড়া রুম প্রতি ৯৫০ হইতে ৪হাজার টাকা পর্যন্ত। হলিডে ইন (মেঘলা) জেনারেল রুম ১হাজার টাকা, নন এসি ১হাজার ৭শত টাকা, এসি ২হাজার ৫শত টাকা।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মারমা সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা ও পরিচিতি
বাংলাদেশের এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি নিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম। বেশীরভাগ আদিবাসীদের বসবাস এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসী জনসংখ্যার দিক দিয়ে মারমা আদিবাসীদের স্থান ২য়। অধিকাংশ মারমাদের বসবাস বান্দরবান জেলায়। বতর্মানে মারমা জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। তাছাড়া কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে কিছু মারমা বা রাখাইন বসবাস করে। কিছু কিছু মারমা নিজেদেরকে “মগ” নামে পরিচয় দিয়ে থাকে।
মারমা শব্দটি “ম্রাইমা” শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার বা বার্মা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা নৃ-গোষ্ঠিদের আগমন। মিয়ানমার ভাষায় মারমা শব্দটি অর্থ “ম্রাইমা”। মারমাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। মারমা নৃ-গোষ্ঠি মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত জাতি। সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। মারমাদের ১০টি গোত্রের উপস্থিত পাওয়া যায়। গোত্র গুলো হচ্ছে রিগো বা খ্যংসা, কক্দাইংসা, মারোসা, ক্যক্ফ্যাসা, ফ্রাংসা, থংসা, প্যালেঙসা, ওয়ইংসা, মুরিখ্যংসা, লংদুসা ইত্যাদি।
জীবন জীবিকাঃ
মারমারাদের বেশীর ভাগ লোকই পাহাড় ও বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। বতর্মানে মারমারা প্রাই শিক্ষিত। চাকুরী ও চাষাবাদের মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জুম চাষ ও বিভিন্ন কাজে মারমা আদিবাসী মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রমী। চাকুরী থেকে শুরু করে সংসারে সমস্ত কাজ ও দেখাশুনা করে। তাই আদিবাসী মারমা সমাজে মেয়েদের সম্মান একটু বেশি। এসব কাজের ফাঁকে কাপড় বুনাসহ হাতের তৈরি নানা রকম কাজ করে। মারমারা বেশি ভাগ হাতে তৈরি পোশাক ও বার্মীজ কাপড় পড়ে থাকেন।
ঐহিত্যগত মারমা সমাজ ব্যবস্থাপনাকে গ্রাম, মৌজা ও সার্কেল তিন পর্যায়ে ভাগ করে পরিচালনা করা হয়। গ্রাম পরিচালনায় প্রধান হচ্ছেন “কারবারী”। মোজা পর্যায়ে “হেডম্যান” এবং সার্কেল প্রধান হচ্ছে রাজা বা মাং। বতর্মানে মারমাদের দুটি সার্কেল বিদ্যমান। খাগড়াছড়িতে মং সার্কেল ও বান্দরবানে বোমাং সার্কেল। বোমাং সার্কেলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ বোমাং সার্কেলের প্রথম রাজা হচ্ছে মংচপ্রু। পিতার নাম রাজা নাইদা বায়িন যার রাজধানী নাম পেগু বার্মা। আরাকান রাজ্যের নামে অধিক পরিচিতি। আরাকান রাজ্যে একটা অংগরাজ্য বোমাংকে পরিচালনা দায়িত্ব দিয়েছিল। যেটা বর্তমান বান্দরবানে “বোমাং সার্কেল”।
বিবাহঃ
মারমা সমাজে বিবাহ প্রথম পর্ব হলো “লাকপাই-পোই” বা প্রস্তুতিমূলক অনুষ্ঠান। যে অনুষ্ঠানটি মূলত আয়োজন করা হয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জানানোর জন্য। উভয় পক্ষের সম্মতিতে ও সামাজিক রীতি অনুসারে পাত্রের পিতা-মাতা বা বন্ধু-বান্ধব কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ প্রথাগতভাবে ব্যবহার্য উপকরণ, যেমন- ১ বোতল মদ, ২৫টি সুপারী, ১বিড়া পান, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, আঁখ ও ১জোড়া নারিকেল নিয়ে কনের বাড়িতে যেতে হয়। এসব উপকরণ কনের মা-বাবাকে প্রদান করে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেয়া হয়। মেয়ের মতামত পাওয়ার পর পাত্রীপক্ষ অনুরূপ আর এক বোতল মদ পাত্র পক্ষকে প্রদান করে। এরপর জ্যোতিষ ডেকে রাশিফল ও বিয়ের দিনক্ষণ ও তারিখ ঠিক করা হয়। সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে পাত্রপক্ষ একটি থামী (মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) রূপা বা স্বর্ণের একটি আংটি দিয়ে পাত্রীকে আশীর্বাদ করেন। বিয়ের ২দিন পূর্বে পাত্রের বাবা বা অভিভাবক নিজ বাড়িতে গৃহ দেবতা উদ্দ্যেশ্য (চুং মং লে) পুজার আয়োাজন করে। পূজাতে দেবতার উদ্দেশ্যে ১টি শুকর. পাঁচটি মুরগী বলি দেয়া হয়। বিয়ের তারিখ ধার্য্য হলে পাত্রপক্ষ থেকে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে ১টি মোরগসহ বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়। বিয়ের দিন সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি অনুসারের পাত্রের বাড়ি প্রবেশ দ্বারে ২টি কচি কলা গাছ, সাদা সুতা দিয়ে পেচানো ২টি পানি ভর্তি কলস (রিজাংও) ও সিফাইক্ও রাখে। বউ আনতে যাওয়ার সময় সিদ্ধ মোরগ, মদ তৈরি হওয়ার পূর্বে ভাত, পানি মুলির সংমিশ্রণ ১ বোতল মদ, ১টি থামি (মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) ও ১ টি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোষাক) সহ নানা উপকরণ নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের দিন সিদ্ধ মোরগটিকে প্রয়োজনীয় উপকরণ মিশিয়ে বর-কনের জন্য একটি পাত্রে পরিবেশন করে। বিবাহ অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পঞশীল গ্রহণ, মঙ্গলসূত্র পাঠ ও পিন্ড দানসহ নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অবশেষে, বিবাহের “লাক্ ছং চা-চ” অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। এরপর থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী রূপে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।
কৃষ্টি-সংস্কৃতিঃ
মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই পোয়েঃ, সাংগ্রাইং, ওয়াছো পোয়েঃ, ওয়াগ্যোয়াই পোয়েঃ, পইংজ্রা পোয়েঃ, ফানুস বাতি উড়ানো, জলকেলি, বৌদ্ধমূতি স্নান, রথযাত্রা এ সবকে প্রদান সামাজিক উত্সব হিসেবে পালন করে থাকে। মারমাদের আদি সংস্কৃতি মধ্যে রয়েছে থালা নৃত্য, পাখা নৃত্য, মাছ ধরা নৃত্য, পাংখুং, জাইক, কাপ্যা প্রভৃতি। নিজেদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মারমা সমাজে খুবই জনপ্রিয়। মাতৃভাষায় রচিত অসংখ্য ভিডিও ও অডিও গান রয়েছে। মারমারা বর্ষবরণকে প্রধান সামাজিক উত্সব হিসেবে পালন করে থাকেন। এ বর্ষবরণকে মারমা তাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই পোয়েঃ বা সাংগ্রাইং উত্সব বলে থাকে। ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে এ উত্সব পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ থেকে মারমাদের সাংগ্রাই পোয়েঃ উত্সব শুরু হয়। এ উত্সব ৪দিন ব্যাপী মারমারা পালন করে থাকে।
বান্দরবান উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী-এর পরিচালক মং নু চিং মার্মা বলেন, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এ তিনটি অধ্যায়কে মারমারা নিজেদের সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ (আবদ্ধ) করেছে। মারমা সমাজের বিভিন্ন গোত্র ও উপ-গোত্রের মধ্যে রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ও সূক্ষ তারতম্য রয়েছে। রীতিনীতি অনুসরণ ও আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে মারমা সমাজে।
লেখক: মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিনিধি, কক্সভিউ.কম,
সভাপতি, লামা রিপোর্টাস ক্লাব, লামা, বান্দরবান।
You must be logged in to post a comment.