সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / কলাম / আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত বিয়ে

আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত বিয়ে

Moung Ba Aung (Moung Ba) 20-3-2016 - Copy

-:   মং বা অং (মং বা)   :-

“জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু এ অবধারিত ঘটনা ত্রয়ের অনুষ্ঠান বিশ্বে সব জাতি ও ভাষাভাষী মানুষ স্ব স্ব নিয়মে আয়োজন করে থাকে। বিশ্বে সব জাতি ও ভাষাভাষী মানুষের বিয়ের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য সাধারণত অভিন্ন হলেও রীতি-নীতি ভিন্নতর। বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ওয়েস্টারমার্ক এর মতে, “বিবাহ এমনই একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে স্ত্রী ও পুরুষ মোটামুটি একটি সহায়ী সম্পর্কে আবদ্ধ হয় এবং ছেলে মেয়ের জন্ম দেয়ার পরও তাদের এ বন্ধন সহায়ী থাকে। ‘পশুপতি প্রসাদ মাহাতো বিয়ের বিষয়ে বলেন ” মানুষের জীবনে ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে সমাজ/গোষ্ঠী বা কৌম কর্তৃক স্বীকৃত নারী- পুরুষের অবৈধ যৌন মিলন, সমতান উৎপাদন, তাদের সামাজিকীকরণ, গোষ্ঠী রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান মেনে স্বামী-স্ত্রী রূপে একত্রে বসবাস করার জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান যে ছাড়পত্র দেয় তাকে বলে বিয়ে”। সাধারণত রাখাইন সমাজে বিয়ের অনুষ্ঠান বৈচিত্র্যময়, জাঁকজমক ও আনন্দঘন পরিবেশে হয়ে থাকে। রাখাইন সম্প্রদায়ের কোন বর্ণ বা গোত্র ভেদ নেই। মূলত অভিভাবকদের পছন্দই কালক্রমে ছেলেমেয়ের পছন্দমত অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানকে প্রথাসিদ্ধ বিয়ে হিসেবে রাখাইন সমাজ স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। প্রাচীনকালে রাখাইন সমাজে বাল্য বিবাহ প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তা চালু নেই। রক্ষণশীল রাখাইন সমাজে এক বিয়ে (Monogamy) অধিক প্রচলিত। বহুস্ত্রী বিয়ে (Polygamy) কিংবা দ্বিস্ত্রীত্ব বিয়ে (Sorotate) তেমন পরিলক্ষিত হয়না। রাখাইন সমাজে কুলগত অর্থাৎ চাচাতো, ফুফাতো ও খালাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না (Cross-Cousin marriage), তবে মামাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হতে পারে (Parrallel-Cousin marriage)। যদিও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় এ ধরনের বিয়েকে নিরোৎসাহিত করা হয়।

রাখাইন সমাজে মুসলমানদের ন্যায় আনুষ্ঠানিক তালাক দেয়া ও পুন: বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন হয় না। স্ত্রী থাকা অবস্থহায় সহোদর কোন বোনকে বিয়ে করা যায় না। স্ত্রীর অবর্তমানে ছোট বোন অর্থাৎ শালীকে বিয়ে করা গেলেও বড় বোনকে বিয়ে করা যায় না। নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও প্রথাগত রীতি-নীতি যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ হয়ে আসলেও লিখিতভাবে বিধান আকারে লিপিবদ্ধ না থাকায় কেউ পুরোপুরি কেউবা আংশিক মানছে। Blood Relation বিদ্যমান থাকার সুবাদে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রেমের টানে কিংবা অন্য কারণে এরূপ ব্যতিক্রমী বিয়ে হলে সমাজে নানাভাবে কটুক্তি শুনতে হয়। একই নৃগোষ্ঠীভুত্তু (Aryan ও Mongolian সংমিশ্রণ জাতি) হওয়ায় রাখাইন ও মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে-শাদী হতে পারে যদিও এরুপ দম্পতির সংখ্যা হাতেগোণামাত্র। উভয় সম্প্রদায়ের বিয়ের রীতি-নীতিতে কিছু ফারাক বিদ্যমান থাকলেও রাখাইন অধ্যুষিত এলাকায় বিয়ে হলে রাখাইন রীতিতে পক্ষান্তরে মারমা অধ্যুষিত এলাকায় বিয়ে হলে মারমা রীতিতে আর ভিন্ন এলাকায় হলে উভয়ের সম্মতি রীতিতে বিয়ে হয়। সুইজারল্যান্ডের ” New Seven Wonderers Foundation” নামীয় বার্নাড ওয়েবার এর ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ২০১০ সালে ২য় বারের মত বিশ্বের প্রাকৃতিক নতুন সপ্তাশ্চার্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার শহরের সম্ভ্রান্ত রাখাইন পরিবারের এক যুবকের সাথে জাপানিজ এক যুবতীর Rakhaing-Japan সংমিশ্রণ রীতিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।

বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে ছেলের অভিভাবকরাই ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রী সন্ধান করে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অতি আপনজনরাই এ ব্যাপারে পাত্রী পক্ষের সাথে প্রাথমিক যোগাযোগ রক্ষা করে। পাত্রীর সম্মতি নিয়ে পাত্রী পক্ষের লোকজন পাত্র পক্ষের সাথে পরবর্তীতে যোগাযোগ করে। ইদানিং ছেলে মেয়ে বিয়ের আগেই হবু জীবন সঙ্গীকে জানা বা দেখার একটা বাসনা থাকে আদিকালে যা কেউ কল্পনাও করেনি। আরো সুষ্পষ্ট করে বলা যায় যে, পিতা-মাতা/অভিভাবক পছন্দই ছেলে মেয়েকে বিয়ে করতে হয়, আবার তাদের পছন্দতে পরিত্যাগ করতে হয়। আজকালকার উন্নত প্রযুক্তি ও তথ্য ভান্ডার যুগে হবু জীবন সঙ্গীকে জেনে শুনে পরিচিত হয়েই বিয়েতে সম্মতি দেয়া কিংবা বিয়ে করা দোষণীয় নয়।

 

যোগ্য, উপযুক্ত ও পছন্দসই পাত্রী সন্ধান পাওয়ার সাপেক্ষে পাত্রীপক্ষকে আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলার জন্য শুভ দিনক্ষণ দেখে একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ইতোমধ্যে পাত্র-পাত্রীর ঠিকুজী, কোষ্ঠী, জন্মবার ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হয়। পরবর্তীতে ধার্য তারিখে পাত্র পক্ষের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও এলাকার গুরুজন সমন্বয়ে ফুল-ফল ও কিছু উপঢৌকনসহ পাত্রীর পিত্রালয়ে গমন করে। পাত্রীপক্ষ তাদের আত্মীয়স্বজন ও এলাকার গুরুজনকে বিয়ের আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলার জন্য আমন্ত্রণ করে রাখে। আলোচনায় “আছন’ ব্যতীত বিবাহোত্তর বর-কনে কোথায় সংসার করবে এ বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হয়। কোষ্ঠী বিচারে পাত্র-পাত্রীর যোটক মিলে গেলে বিয়ে পাকাপাকি করা হয়। রাখাইনদের বিয়েতে কোন পণপ্রথা প্রচলন নেই বলে লিখিতভাবে কোন চুক্তি থাকে না। সুর্দীঘকাল থেকে পাত্রীকে নিদির্ষ্ট ওজনে স্বর্ণালংকার, পোষাক-পরিচ্ছদ ও প্রসাধনী সামগ্রী দেয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। যাকে রাখাইন ভাষায় “আছন/ Ah Thon’ বলে। বাংলাভাষী উচ্চবর্ণের হিন্দুর বিয়েতে কনেপণ না থাকলেও বরপণ রয়েছে। মুসলমানদের ন্যায় কণেপণ প্রথা প্রচলিত না থাকায় রাখাইন অভিভাবক তথা রাখাইন মেয়েরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।

রাখাইন বিয়েতে যৌতুক প্রথা প্রচলন না থাকায় যৌতুকের জন্য বিয়ে বিচ্ছেদ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনা বিরল। মুসলমানদের কনেপণ (মোহরানা) না হলে ব্যতিক্রমছাড়া বিয়ে হয়না। সুরা নিসায় এক আয়াতে বলা হয়েছে -‘তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) থেকে যে স্বাদ (যৌন) আস্বাদন করেছ তার বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী তাদের মোহর পরিশোধ করো।” মোহরানা নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম উপাদান যা নারীকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব/ অসম্মতি কিংবা জেদের বশবর্তী হয়ে মন:মিলনে পলায়নের মাধ্যমে কিছু বিয়েও (Informal marriage) রাখাইন সমাজে হয়ে থাকে। সমাজ এরূপ বিয়েকে সমর্থন না করলেও পরবর্তীতে এরূপ দম্পত্তি প্রথাসিদ্ধ বিয়ের মূল পূর্ব অবশ্যই সম্পাদন করে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করতে হয়।

পিতৃতান্ত্রিক রাখাইন সমাজ ব্যবস্থয় বিয়ের পর বধূকেই শ্বশুরালয়ে অবস্থান করতে হয়।   উভয়পক্ষ এ বিষয়সহ অন্য সব বিষয়ে সমঝোতা হয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনা বা বাগদান (Engagement) সম্পন্ন করে। সমযোজনক আলোচনার পর পাত্রীকে পাত্র পক্ষ থেকে স্বর্ণের আংটি পরানো হয় এবং আর্শীবাদ করা হয় যদিও তা বাধ্যতামূলক নয়। অত:পর বৌদ্ধ পুরোহিত বা জ্যোতিষী কর্তৃক পাত্র-পাত্রীর ঠিকুজী, কোষ্ঠী ইত্যাদি দেখে দিনক্ষণ বিবেচনা করে শুভাশুভ নির্ণয় পূর্বক   বিয়ের তারিখ ও লগ্ন ধার্য করা হয়। বিয়ের তারিখ নির্ধারণে অবশ্য পরিবার প্রধান ও পারিবারিক সুসময়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাখাইন সমাজে তালাক দেয়া, বিয়ে বিচ্ছেদ, বহুবিবাহ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বর কনের কক্ষসহ বাড়িকে পরিপাটি করে সাজানো হয়। সতেজ ফুল, হরেক রঙ্গের কাপড়, কাগজ ও বর্ণিল বেলুন দ্বারা বিয়ের আসর সাজানো হয় এবং বাড়ির আশপাশে আলোকসজ্জা করা হয়। সাধারণত গৃহের মধ্যকক্ষকে বিয়ের আসর হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কিছুদিন আগেও শহর এলাকায় বিয়ের অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো হত, তবে এখন কেউ মাইক বাজাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। গ্রামাঞ্চলে বিয়েতে এখনো মাইক বাজতে শোনা যায়। বিয়ের আগের দিন বর/কনের বাড়িতে সমাজি লোকজনকে ডেকে কিভাবে বিয়ে সমাধা করা হবে তা আলোচনা (পানশল্লা) করা হয়।

সন্ধ্যার দিকে কনে কয়েকজন বান্ধবীকে সাথে নিয়ে এলাকার সমবয়সী মেয়েদের আমন্ত্রণ করে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। এ সময় মেয়েরা আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। অনেকে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যার্পণ করলেও কয়েকজন কনের সাথে অবস্থান করে আমোদ ফূর্তি করে রাত্রিযাপন করে। এদিকে বরের আমন্ত্রিতরা বরের বাড়িতে সন্ধ্যার দিকে দলে দলে সমাগত হতে থাকে। Bechelor Night হিসেবে আনন্দের আতিশয্যে অনেক বরপক্ষকে Cocktail Party আয়োজন করতে দেখা যায়। ইদানিং রাখাইন বিয়েতে রাতে ব্যান্ড শো আয়োজন করতে দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে বিয়েতে পাড়ার যুবনেতার উল্লেখ করার মত ভূমিকা থাকে। যুবনেতার (অবিবাহিত) নেতৃত্বে এলাকার তরুণরাই বিয়েতে আপ্যায়নসহ স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে। বর বা তার কর্তৃক মনোনীত একজন ব্যক্তি যুবনেতার সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের প্রচলিত প্রাপ্য হিসাবে নিদির্ষ্ট ওজনে গৃহ নির্মিত মদ (Rice Juice) প্রদান করতে হয়। বিয়ের দিন ভোর বেলায় বর ও কনের বাসায় আগমনের নিমিত্ত নিদির্ষ্ট ধর্মীয় পুরোহিতকে দু’একদিন আগে থেকে আমন্ত্রণ করতে হয়। বিয়ের দিন ভোরবেলায় নিমন্ত্রিত বৌদ্ধ পুরোহিত বর/ কনের বাসায় গিয়ে বর/ কনের কক্ষে বর/কনেসহ উপস্থিত সকলকে পঞ্চশীলে দীক্ষিত করে এবং পুরোহিত যথানিয়মে মংগল সূত্র (বিয়ের মাঙ্গলিক মন্ত্র) ও ত্রিরত্ন বন্দনা করেন। এ সময় বর/কনের সাথে নিদির্ষ্ট সংখ্যক বন্ধু বান্ধবী, আত্মীয়স্বজন ও অভিভাবক পরিবেষ্টিত থাকে। বর/কনেকে নব সাজে সজ্জিত হতে হয়। পুরোহিত বর/কনে বিবাহিত জীবন সুন্দর, সফল, সার্থক কামনা করে নিজ গন্তব্যে প্রস্থান হন। অত:পর বর/কনেকে প্রথমে পিতা-মাতা/অভিভাবক স্বর্ণালঙ্কার, নগদ অর্থ উপহার সামগ্রী প্রদান করে এবং আর্শীবাদ করে। বর/কনে এ সময় অভিভাবককে নিজস্ব রীতিতে প্রণাম করে। পরে বন্ধু-বান্ধবী ও আমন্ত্রিত অতিথিরা বর/কনের কক্ষে এসে উপহার সামগ্রী প্রদান করে। একদা নগদ অর্থই ছিল বিয়েতে একমাত্র উপহার। হালে নগদ অর্থের পাশাপাশি বর্তমানে স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তু (Utility Goods) সামগ্রী উপহার স্বরূপ প্রদান করতে দেখা যায়। প্রত্যোত্তরে বর/কনে উপহার দাতাকে বয়স অনুপাতে ঘরে নির্মিত পান, চুরুট, নানা ব্রান্ডের সিগারেট, চকলেট, শুভেচ্ছা কার্ড ইত্যাদি প্রদান করে থাকে। বর/কনের সাথীরা কিংবা তাদের ছোট ছোট আত্মীয়রা উপহার দেয়ার ছলে নানাবিধ হাস্যোদ্দীপক উপহার সামগ্রী প্রদান করে হাসি তামাশা করে মজা উপভোগ করে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হয় বিকেল বেলায়। রাখাইনদের বিয়ে সাধারণত চলন্ত অর্থাৎ কনের পিতৃ গৃহে অনুষ্ঠিত হয়। রাখাইনরা নামন্ত বিয়ে করে না। তবে বিশেষ কারণে ধর্মীয় পুরোহিত কিংবা জ্যোতিষীর বয়ানের উপর ভিত্তি করে কনে পক্ষ বরের এলাকায় অবস্থান করেও চলন্ত বিয়ের পর্ব সম্পাদন করা যায়। বরযাত্রা গমনের পূর্বে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকে সজ্জিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে একদল বিবাহিত রমণী প্যাগোডা বা ‘জাদি’র সদৃশ ঢাকনাযুত্তু একটি বিশেষ পাত্র সাজি বা ডালা বহন করে কনের বাড়িতে গমন করে। এসব ডালার অভ্যন্তরে থরে থরে সাজানো থাকে কনের জন্য স্বর্ণালংকার, পোষাক, প্রসাধন, তাজা ফুল, পান, তামাক ও খাবার সামগ্রী। “ঔ’ বহনকারী দলে সর্বাগ্রে থাকা রমণীকে সন্তানসহ অবশ্য সধবা এবং বর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মনোনীত হতে হয়। বরের বোন বা ভাবীরাই উক্ত “ঔ’ (“আন্যেং-ঔ’) বহন করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়।

বরযাত্রায় একদা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হলেও কালের বিবর্তনে আধুনিক ঢোল বাদ্যযন্ত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে। কনের পিত্রালয়ের দূরত্বানুযায়ী পদব্রজে বা গাড়ি/নৌ বহরে কিংবা উভয়ভাবে বরযাত্রা করা হয়। বরযাত্রা দলে অগ্রভাগে এলাকার গুণীজন, মধ্য ভাগে “ঔ’ বহনকারী রমণী দল এবং শেষভাগে বর ও তার সাথীরা থাকে। সাথীরা বরের পরিধেয় বস্ত্রের ব্যাগ/ ব্রিফকেস, বিছানার কাপড় সমেত পাতি, একটি তরবারি, রেজাংও, ধুমপানের পাইপ, পানের কৌটা, পাখা ইত্যাদি বহন করে। এ সময় বর মাথায় মুকুট, গায়ে সার্টের উপর একটি বারেষ্টার জাতীয় সার্ট, রাখাইন ঐতিহ্যের বর্ণাঢ্য লুংগির উপর নয় হাত লম্বা বিশিষ্ট একটি বিশেষ লুংগি ও একটি বৃহৎদাকার শাল পরিধান করে। “ঔ’বহনকারীরা কনের বাড়িতে সরাসরি উঠলেও বর অন্যান্যদের সাথে গৃহের নীচে থেকে যায়। নিজস্ব পাতি বিছিয়ে তার উপর সাথীসহ বর অবস্থান করে। বহনকৃত “ঔ’ এর বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে একটিতে সুগন্ধীযুক্ত সরু বিন্নী চাল থাকে। এ চালের সাথে কনের বাড়িস্থ অনুরূপ চাল মিশিয়ে এক ধরনের বিশেষ মাঙ্গলিক খাবার তৈরী করা হয়। রান্না চলাকালীন সময় কনের বান্ধবীরা গান গেয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা হঁলা জাতীয় এক ধরনের সমবেত গীত পরিবেশন করলেও শহুরে মেয়েরা এসবে অভ্যস্ত নয়। এ সময় কনের বান্ধবী ও ছোট ছোট আত্মীয়রা নীচে বসা বরকে সুগন্ধীযুক্ত জল, পুস্প, খই ইত্যাদি নিক্ষেপ করে স্বাগত ও অভিনন্দন জানায় এবংবরকে কনের গৃহস্থ সুপেয় মিষ্টির জল, পান, চিনি খাওয়ানো হয়। এ ফাঁকে কনেকে অপরূপ সাজে সাজানো হয়। কনে এ সময় ঐতিহ্যবাহী পোষাক, গায়ের উপর একটি শাল এবংমাথায় একটি বর্ণময় ওড়না পরিধান করে। মাথার চুলকে বেঁধে সুন্দরভাবে খৌঁপা তৈরী করা হয়।

বর পক্ষ থেকে প্রদত্ত স্বর্ণালংকার ও নিজ পিতামাতা/অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় স্বর্ণালংকার দিয়ে কনেকে সাজানো হয়। আধুনিক কনেগণ দক্ষ বিউটিশিয়ান দ্বারাই সজ্জিত হতে অধিকতর পছন্দ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সমাধা আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কনেকে ঐ ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হয়। বাগদান অনুষ্ঠানে ধার্যকৃত “আছন’ এ সময় কনের পক্ষকে স্থানীয় গুণীজনদের উপস্থিতিতে হস্থান্তর করতে হয়। বরের পক্ষে মা, বোন, ভাবীরাই “আছন’ হস্থান্তর করেন বা কনেকে পরিয়ে দেন। বরের পক্ষে কেউ মাঙ্গলিক খাবার তৈরী সম্পন্ন হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে কনের পক্ষ থেকে হ্যাঁ/না সূচক জবাব দিতে হয়। কনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ বার্তার প্রাপ্তির পরই বর কয়েকজন সাথীকে নিয়ে সংগে নেয়া জিনিসপত্র সমেত কনের গৃহে প্রবেশ করে। গৃহে প্রবেশের সময় তরবারি বহনকৃত ব্যক্তি সিঁড়িকে সাতবার মৃদুভাবে আঘাত করে। সিঁড়িতে পা ধোয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন গেইট/দরজা পার হয়ে কনের কক্ষে প্রবেশ পর্যন্ত কনের বান্ধবী ও আত্মীয়দেরকে নগদ অর্থ দক্ষিণা প্রদান করতে হয়। কনের গৃহে প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত মঙ্গল পাত্রের বরকে হাত ডোবাতে হয়। ফিতা কেটে বরকে বিয়ের   আসরে   প্রবেশ করার প্রথা বরগুণা-পটুয়াখালী অঞ্চলে রাখাইনদের মাঝে পরিলক্ষিত হলেও কক্সবাজারে সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না। বিয়ের আসরে বরের কয়েকজন বন্ধু ও কনের পক্ষে কয়েকজন মহিলা থাকে। একজন বর্ষীয়ান পুরুষ/মহিলা অন্যান্যদের সহায়তায় নিজেদের চিরাচরিত রীতিনীতি ও প্রচলিত বিধিবিধান পালন করেই বিয়ের মূল পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে সুচারূপে পরিচালনা করেন। কনে পূর্ব থেকে বিয়ের আসরে অবস্থান করে থাকে। বরকে কনের ডান পাশে বসানো হয়। বরের পক্ষ থেকে নিয়ে আসা “রেজাং-ও’ জোড়াকে কনের কক্ষে স্থাপিত রেজাংও জোড়ার পাশে রেখে সুতা দিয়ে সাত পাক পেচানো হয়। অত:পর বর ও কনেকে অনুরূপ সুতা দিয়ে সাত পাক পেচানো হয়। উভয়ের শালের কোণদ্বয় বেঁধে দেয়া হয় এবং একটা শালের অভ্যন্তরে বরের বাম হাতের কনিষ্ঠ অঙ্গুলীর সাথে কনের ডান হাতের কনিষ্ঠ অঙ্গুলী অল্প ক্ষণের জন্য গেঁথে দেয়া হয়। বিয়ে পরিচালিত ব্যক্তি দু’জনের হাতে হাত মিলিয়ে দেন এবং বর কনের হাত পরস্পর সাতবার হাতের উপর হাত রেখে তার উপরে পানি ঢেলে দেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পানি ঢালাকে মঙ্গল কার্যের স্বীকৃতি হিসেবে গণ্য করা হয়। বরকে তার মস্তকের উপর স্থাপিত মুকুটকে কনের মস্তকের উপর স্থাপিত মুকুটের উপর প্রতিস্থাপন করতে হয়। মুকুটের উপর মুকুট প্রতিস্থাপনের পর কনে বরকে প্রণাম করতে হয় এবং প্রণামের বিনিময়ে বরকে উপহার প্রদান করতে হয়। এ সময় মাঙ্গলা পাত্রের ভাত বর কনে পরস্পরকে সাতবার খাওয়াতে হয়।

বিয়ে পরিচালিত ব্যক্তিরাই পাঠানোমতে মঙ্গল ঘটের নানা সুগন্ধযুক্ত জলমাখা পল্লব দিয়ে সাত বার বর কনের উপর নিক্ষেপ করে এবং বিবাহিত জীবন সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপনান্তে তিনি ঘোষণা করে দেন যে বিয়ের সকল আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে, তারা এখন থেকে স্বামী স্ত্রী হিসাবে সমাজে বসবাস করতে পারবে। এক কথায় বলা যায় তারা সমাজ থেকে বিয়েত্তোর সামাজিক ছাড়পত্র লাভ করেছে। মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিধানুসারে মুসলমানদের বিবাহে আইনত লিখিত কাবিন হতে হয়। কাবিননামা নিকাহ্ রেজিষ্ট্রার সম্পাদন করত তা স্ত্রীই একমাত্র পাওয়ার অধিকারী বিধায় তাকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। পক্ষান্তরে রাখাইনদের বিয়েতে এ ধরনের কোন কাবিননামা বা দলিল সংরক্ষিত থাকে না। বার্মিজদের (বা মা) বিয়েতে অভিভাবক, সাক্ষীসাবুদসহ বর কনেকে নির্ধারিক কোর্টে হাজির হয়ে চুক্তিনামা সম্পাদন করতে হয়। দেশে বসবাসরত রাখাইনদের সাথে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রাখাইনদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, কৃস্টি, ঐতিহ্য ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজন বা উদযাপনে যথেষ্ঠ মিল থাকলেও বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কয়েকটি ঐতিহ্যগত রাখাইন বিয়ে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে বলা যায় যে, যুগ বিবর্তনে রাখাইন বিয়ের রীতিতে সামান্য হলেও আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া সূচনা হয়েছে।

পরিচিতি- লেখক ও গবেষক

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

https://coxview.com/wp-content/uploads/2024/04/Election-Sayed-Alam-Sagar-21-4-24.jpeg

ঈদগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান ছৈয়দ আলম নির্বাচনী জনমত জরিপে এগিয়ে

  নিজস্ব প্রতিনিধি; ঈদগাঁও :কক্সবাজারের ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এবার ভিন্ন পরিসরে প্রচারণায় চালিয়ে যাচ্ছেন ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/