সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / কলাম / ঐতিহাসিক ছয় দফাঃ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়

ঐতিহাসিক ছয় দফাঃ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়

-: এডভোকেট ফখরুল ইসলাম গুন্দু :-

বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিবাদী আত্মত্যাগের ভাস্বর আজকের দিন। আজ ঐতিহাসিক ৭জুন, ছয় দফা দিবস। আজকের এই দিনে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয়দফা দাবি। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপি উত্তপ্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। আজকের এই দিনটি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে স্পষ্টকরে নতুন পর্যায়ে উন্নত করে। আর এই ছয় দফার মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল। ছয়দফা আন্দোলনের ধারাবহিকতায় আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, এগারো দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ নামের একটি ভূখন্ড। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল।

পেছনের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপন করেন এবং পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব প্রদান করেনি। তারা এ দাবি প্রত্যাখান করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা উত্থাপন করেন। সেদিন পাকিস্তানের ততকালীন সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফা মোকাবিলায় ঘোষণা দিয়েছিলেন। ছয় দফা সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামীলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মাস ব্যাপী ছয় দফা প্রচারে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক সিলেটের মনু মিয়া পাকিস্তান স্বৈরশাসকের গুলিতে প্রাণ হারান। এতে বিক্ষোভের প্রচন্ডতা আরো বাড়ে। তেজগাঁওয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আজাদ এনামেল এ্যালুমিনিয়াম কারখানায় শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন। একই দিন নারায়নগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যায় আরো ৬ শ্রমিক। আন্দোলনের প্রচন্ডতায় লাখো বাঙালি মাঠে নেমে পড়ে। সন্ধ্যায় জারি করা হয় কারফিউ। রাতে হাজার হাজার আন্দোলনকারী বাঙালিদের গ্রেফতার করা হয়। এমনিভাবে ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্দোলন।

সম্মানিত পাঠকমন্ডলীর সুবিধার জন্য “আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি” গ্রন্থ থেকে ছয় দফা’র বিস্তারিত উত্থাপন করা হলঃ

১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনুভব করেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাঙালিরে ন্যায্য অধিকার স্বায়ত্তশাসন কখনোই দেবে না। পশ্চিমারা পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশ অর্থাৎ কলোনি হিসেবেই বিবেচনা করেছে। তারা চিরকালই শোষণ করবে বাঙ্গালিদের। দুই পাকিস্তানে যে উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে সামান্যতমও কোনো সমতা নেই। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বেশির ভাগই গৃহীত হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।

১৯৬৬ সালের ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি জেনারেল আইয়ুব সরকার লাহোরে সমগ্র পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করেন। সম্মেলনে ঘনিষ্ট সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং আবদুল মালেক উকিল প্রমুখ রাজনীতিবিদদের সাথে নিয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর গমন করেন। রাজনীতিবিদদের এই সম্মেলনে যারা পাকিস্তানের ৮৪০ জন অংশগ্রহণকারীর অধিকাংশ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। পূর্ববাংলার প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র ২১ জন।

৬ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির অধিকার অর্জনের দাবি ‘ছয় দফা’ পেশ করেন। কিন্তু সম্মেলনে অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এই ‘ছয় দফা’ নিয়ে কোনো রকম আলোচনা করতেও অস্বীকৃতি জানান। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে ছয় দফা দাবি পেশ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘোষিত ৬ দফা ছিলো এ রূপ:

১ম দফা :

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়ে তুলতে হবে এবং সরকার থাকবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের সরাসরি ভোটে সব ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

২য় দফা :

কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকবে। অন্যান্য সকল ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।

৩য় দফা :

মুদ্রার ব্যাপারে দুটি প্রস্তাব দেয়া হয়, যার একটি গ্রহণ করলেই চলবে।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সহজে বিনিময়যোগ্য আলাদা আলাদ মুদ্রা থাকবে এবং কারেন্সি কেন্দ্রীয় সরকার নয়, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। অথবা দুই অঞ্চলে একই মুদ্রা চালু থাকতে পারে। তবে এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের পাচার না হতে পারে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থ বিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

৪র্থ দফা :

খাজনা, ট্যাক্স কর আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারে কোনো রূপ কর ধার্যের সামান্যতম ক্ষমতাও থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য আঞ্চলিক রাজস্বের একটি অংশ ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকার প্রাপ্য হবে।

৫ম দফা :

বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা হবে নিম্নরূপ:

দুই অঞ্চলের বৈদেশিক অর্থ আয়ের আলাদা আলাদা হিসাবে রাখতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে থাককে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় মুদ্রা উভয় অঞ্চল থেকে সমানভাবে নিতে হবে। দেশীয় পণ্য বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি চলবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং আমদানি রফতানি বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন ও বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং আমদানি রফতানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে।

৬ষ্ঠ দফা :

পূর্বপাকিস্তানকে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং পাকিস্তানের নৌ-বাহিনীর প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করতে হবে।

আমাদের বাঁচার দাবী ৬ দফা কর্মসূচি

৬ দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালি জাতির নিকট ব্যাখ্যা করলেন। তিনি তাতে বললেন,

না করায় বঙ্গবন্ধু বাধ্য হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবী ৬ দফা দাবী উত্থাপন করলেন এই ভাবেই-

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা

আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবী রূপে ৬ দফা কর্মসূচি দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমি স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করেছেন। জনগণের দুশমনদের এ চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এ দালালরা এমনিভাবে হৈ হৈ করিয়াই উঠেছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয় শিক্ষা লাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এ শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের আবিস্কার করেছেন।

আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবীতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করবার দুরভিসন্ধি আরোপ করছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে, সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি, তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল এসেছে। সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামীলীগ আমার ৬ দফা দাবী অনুমোদন করছেন। ফলে ৬ দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থার কায়েমী স্বার্থী শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে। কিন্তু এও আমি জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার তাদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সূর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী।

ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এরা আছেন সরকারি দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলার এর সকলে একজোট। এরা নানা ছলা-কলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করবেন। সে চেষ্টা শুরুও হয়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিস্কাম সেবার জন্য এরা ইতিমধ্যেই বের হয়ে পড়েছে। এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হবেন না তাতেও আমার কোন সন্দেহ নেই। তথাপি ৬ দফা দাবীর তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী, বিশেষত আওয়ামীলীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি, তারা সকলে অবিলম্বে ৬ দফার ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়িয়ে পড়বেন।

কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধরণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬ দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ারী সহজ-সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এ পুস্তিকা প্রচার করলাম। আওয়ামীলীগের তরফ হতেও এ বিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামীলীগের কর্মীগণ ছাড়া ও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানি মাত্রেই এসব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করবেন।

১ নং দফা

পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত-বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।

এতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে-আজমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হয়েছিলো। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়েছিলেন এ প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে ২১ দফার পক্ষে এসেছিলো, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবী ছিলো তার অন্যতম প্রধান দাবী।

মুসলিমলীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া হয়েছিলো। তথাপি পূর্ববাংলার ভোটাররা এ প্রস্তাবসহ ২১ দফার পক্ষে ভোট দিয়েছিলো।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলতে গেলে এ প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক রচনার দাবী করে আমি কোন নতুন দাবী তুলি নাই; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরানো দাবীরই পুনরুল্লেখ করেছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনলেই যাঁরা আঁতকে ওঠেন, তারা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা প্রস্তাবই ভালো, না প্রেসিডেনসিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাহীন আইনসভাই ভালো, এ বিচার-ভার জনগণের উপর ছাড়িয়ে দেওয়া কি রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করছেন কেন? তারা যদি নিজেদের মতো এতোই আস্থাবান, তবে আসুন এ প্রশ্নের উপরই গণভেট হয়ে যাক।

২নং দফা

এ দফায় আমি প্রস্তাব করেছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ার কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এ দুইটি বিষয়ে থাকবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয়ে স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে ‘প্রদেশ’ বলা হয় হাতে) থাকবে। এ প্রস্তাবের দরুনই  কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশি চটেছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করে ধ্বংস করার প্রস্তাব দিয়েছি। সঙ্কীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি এদের এতই অন্ধ করে ফেলেছে যে, তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো পর্যন্ত ভূলে গিয়েছেন। এরা ভুলে যাচ্ছেন যে, বৃটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প্ল্যান’ দিয়েছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান’ কংগ্রেস ও মুসলীমলীগ উভয়েই গ্রহণ করেছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ তিনটি মাত্র বিষয় ছিলো এবং বাকী সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিলো।

ইহা হতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃটশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ সকলের মত এই যে, এ তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তি ভঙ্গ করায় ক্যাবিনেট প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। তা না হলে এ তিন বিষয় নিজেই আজো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চলতে থাকতো। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্লানরই অনুসরণ করেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়েছি সত্য, কিন্তু তার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। অখন্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখন্ডতা ছিলো।

ফেডোরেশন গঠনের রাষ্ট্র-বৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং ষ্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এ মূলনীতি অনুসারে অখন্ড ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিলো। পেশাওয়ার হতে চাটগাঁ পর্যন্ত একই রেল চলতে পারতো। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা হাতে ট্রান্সফার করে বর্তমান সরকারও তা স্বীকার করেছেন। টেলিফোন-টেলিগ্রাম-পোষ্টাফিসের ব্যাপারে ও তা সত্য স্বীকার করতেই হবে।

তবে বলা যেতে পারে যে, একুশ দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দিবার সুপারিশ ছিলো, তখন আমি আবার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুই বিষয় দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাবে আমি ৩নং দফায় ব্যাখ্যা দিয়েছি। এখানে আর পুনরুক্তি করলাম না। আরেকটা ব্যাপারে ভূল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলে ‘ষ্টেট’ বলেছি। এতে কায়েমী স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলে ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করেছিলো যে, ‘ষ্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেট ষ্টেট’ বা ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ বুঝিয়েছি। কিন্তু তা সত্য না। ফেডারিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশইে ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলে ‘ষ্টেটস্’ বলা হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ‘ফেডারেশন’ অথবা ‘ইউনিয়ন’ বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমন কি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে ‘ষ্টেট’ হওয়ার সম্মান হতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এটুকু নামের মর্যদা দিতেই বা কর্তারা এতো এলার্জিক কেন?

৩নং দফা

এ দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অল্টারনেটিভ প্রস্তাব দিয়েছি। এ দুটি প্রস্তাবের যে কোনো একটি গ্রহণ করলেই চলবে:

ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলণ করতে হবে। এ ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ‘ষ্টেট’ ব্যাংক থাকবে।

খ. দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকবে। এ ব্যবস্থায় এ মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। এ বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে; দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

এ দুটি বিকল্প প্রস্তাব হতে দেখা যাবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রের হাত হতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ গৃহীত নয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থেকে যাবে। ঐ অবস্তায় আমি একুশ দফা প্রস্তাবের খেলাফ কোনো সুপারিশ করেছি, একথা কোন ক্রমেই বলা চলে না।

যদি পশ্চিমপাকিস্তানি ভাইরা আমার এ প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভূল বোঝাবুঝির অবসান হলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এ প্রস্তাবে রাজী হবেন। আমরা তাদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করে সংখ্যা-সাম্য মানিয়া নিয়েছি,তারা কি আমাদের খাতিরে এটুকু করবেন না?

আর যদি অবস্থাগতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনতেও হয়, তবু তাতে কেন্দ্র দুর্বল হবে না। পাকিস্তানের কোনো মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিলো না। ঐ প্রস্তাব পেশ করে বৃটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেস ও মুসলীমলীগ সকলেই স্বীকার করেছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করেও কেন্দ্র চলতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থ-বিজ্ঞানে এ ব্যবস্থার স্বীকৃতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকার নজির দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রেও আছে।

খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে পৃথক পৃথক ষ্টেট ব্যাংকের দ্বারা। এতে যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস হয় নাই; তাদের আর্থিক বুনিয়াদও ভেঙ্গে পড়েনি। এতো যে শক্তিশালী দোর্দন্ডপ্রতাপ সোভিয়েট ইউনিয়ন, তাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের ও অর্থমন্ত্রি বা অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রি ও মন্ত্রি দফতর দিয়েই মিটিয়ে থাকে। দক্ষিণ আফিক্রার মতো দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাংক বহুদিন আগে হতেই চালু আছে।

প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরোক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্বপাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লেখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাতে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্পও গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শনস্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা হইবে।

একটু তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাবে যে, এ দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহণ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় নাই। সবার পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোন পৃথক চিহ্ন না থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সী সার্কুলেশনে কোনো বিধি-নিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, ইনসিওরেন্স ও বৈদেশিক মিশনসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এ পাচারের কাজে অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারি ষ্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ সমস্ত ব্যাংকের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এ সেদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দু’একখানি ব্যাংক ইহার সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম মাত্র। এ সব ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প-বাণিজ্যের আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি এক কথায় পূর্বপাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মতো একটানে তলদেশে হেড অফিসে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে, পূর্ব পাকিস্তান শুকনা বালুচর হইয়া যাইতেছে।

বালুচরে পানির দরকার হলে টিউবওয়েল খুঁড়িয়া তলদেশ হতে পানি তুলতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্বপাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউবওয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হতে আনতে হয়। উদ্ধৃত আর্থিক সেভিং তলদেশেই অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটেল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে। বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোনো দিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবে না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।

শুধু ফ্লাইট অব ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতি হেতু পূর্ব পাকিস্তানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দুমূর্ল্য, জনগণের বিশেষত পাটচাষীদের দুর্দশা সমস্তের জন্য দায়ী এ মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি ৫নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, জন্য দায়ী এ মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি ৫নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, এই ফ্লাইট-অব-ক্যাপিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানিরা নিজেরা শিল্প-বাণিজ্যে এক পা-ও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারণ এ অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পারে না।

৪নং দফা

এ দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।

আমার এ প্রস্তাবেই কায়েমি স্বার্থের কালোবাজারী ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশি চমকিয়া উঠিয়াছে। তারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের না থাকিলে সে সরকার চলিবে কীরূপ? কেন্দ্রীয় সরকার তাতে যে একেবারে খয়রাতি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে। খয়রাতের উপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্রনীতিই বা চালাইবেন কি দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাঁদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তো অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এটা নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র।

কায়েমি স্বার্থীরা এ ধরনের কতো কথাই না বলিতেছেন। অথচ এর একটা আশঙ্কাও সত্য নয়। সত্য যে নয় সেটা বুঝিবার মতো বিদ্যা বুদ্ধি তাদের নিশ্চয়ই আছে। তবু যে তারা এসব কথা বলিতেছেন, তার একমাত্র কারণ তাদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত স্বার্থ। সে স্বার্থ পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুন্ঠন করার অধিকার। তারা জানেন যে, আমার এ প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের দায়িত্ব দেওয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মতো যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। এটাই সরকারি তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তারা এটাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত। তারা এ খবরও রাখেন না যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান বৃটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিলো; কেন্দ্রকে সে ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই।

৩নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রি ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েট ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রি বা অর্থদফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নাই। তাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী ও পররাষ্ট্র দফতরে কি সে জন্য দূর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দূর্বল হইবে না। কারণ আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই যে টাকা ট্যাক্স ধার্য ও আদায় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সে টাকার হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকায় আঞ্চলিক সরকারের কোনো হাত থাকিবে না। এ ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা হইবে।

দ্বিতীয়ত, ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের জন্য কোনে দফতর বা অফিসার বাহিনী রাখিতে হইবে না।

তৃতীয়ত, অঞ্চলে ও কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের মধ্যে ডুপ্লিকেশন হইবে না। তাতে আদায়ী খরচায় অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ হইবে। এভাবে সঞ্চিত টাকার দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসার বাহিনীকেও উন্নততর সৎকাজে নিয়োজিত করা যাইবে। চতুর্থত, ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের একীকরণ সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থ-বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিংগল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিংগল ট্যাক্সেশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসু বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। ট্যাক্সেশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ারভুক্ত করা এ সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে।

৫ নং দফা

এ দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছি:

দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানের এখ্তিয়ারে থাকিবে।

ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।

দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী-রফতানী চলিবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী-রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।

পূর্বপাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এ ব্যবস্থা ৩নং দফার মতোই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠারো বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলে দেখা যাইবে যে,

ক. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্প-জাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে।

খ. পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্বপাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্বপাকিস্তানের নাই- এ অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।

গ. পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণ ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্বপাকিস্তান যে পরিমান রফতানী করে আমদানী করে সাধারণত তার অর্ধেকেরও কম। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্বপাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মতো লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্যব্যাদির দাম এতো বেশি। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি দামের তুলনা করিলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বন্টনের দায়িত্ব ও এবং অথনৈতিক অন্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ার থাকার ফলেই আমাদের এ দুর্দশা।

ঘ. পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাটচাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম নিতে পারেন না। এমন অদ্ভূত অর্থনীতি দুনিয়ার আর কোনো দেশে নেই।

যতো দিন পাট থেকে চাষীর ঘরে, ততো দিন পাটের দাম থাকে পনেরো-বিশ টাকা। ব্যবসায়ীর গুদামে চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরীব চাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট-ব্যবসায় জাতীয়করণ করিয়া পাট রফতানীকে সরকারি আয়ত্তে আনা ছাড়া এর কোনো প্রতিকার নাই, একথা আমরা বহুবার বলিয়াছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামীলীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সে আরাদ্ধ কাজে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।

ঙ. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তা নয়, আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী লোন ও এইড আসিতেছে, তাও পশ্চিমপাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্তু সে লোনের সুদ বহন করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। ঐ অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মুল্য দিতে হইলে, আমদানী-রফতানী সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তা দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করিয়া তাদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পূর্ব দিয়া পূর্ব পাকিস্তানির হাতে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ন্তর নাই।

৬নং দফা

এ দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফার দাবীতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবী করিয়াছিলাম। তা তো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তানি সরকারের অধীনস্থ ই.পি.আর. বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র-কারখানা ও নৌ-বাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করত এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবী একুশ দফার দাবী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বারো বছরে আমাদের একটি দাবীও পূরণ করেন নাই।

পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানির বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবী করিতে হইবে কেন? সরকার নিজ হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতেরো দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই আমরা কতো নিরুপায়? শত্রুরা দয়া ও মর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যত আমাদেরকে তাই করিয়া রাখিয়াছে।

তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনী গঠিন করুন। নৌ-বাহিনী অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌ-বাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এ সব কাজ  সরকারে কবে করিবেন জানি না। কিন্তু ইতিমধ্যে অল্প খরচে ছোটখাটো অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করিতেও পশ্চিমা ভাইদের এতো আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা উঠিলে তাও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়া যাওয়া হয় কেন? ঐ সব প্রশ্নের উত্তর নাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরিবী হালেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবী কি অন্যায়? এ দাবী করিলেই সেটা হইবে দেশদ্রোহিতা?

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি ভাই-বোনদের খেদমেত আমার কয়েকটি আরজ আছে:

এক. তারা মনে করিবেন না আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকার দাবী করিতেছি। আমার ৬ দফা কর্মসূচিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাবীও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবী স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানিরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।

দুই. আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিমপাকিস্তানে পাচার ও স্তুপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন। যতো দিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততো দিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এ অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষনও বন্ধ করিতে হইবে। আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ী আমাদের ভৌগলিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া সে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা।

ধরুন, যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি দফরতই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা-সুবিধা হইত একটু বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা বাষট্টি টাকা খরচ হয়। দেশরক্ষা বাহিনীতে এবং শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায়। এ একুশ শতকরা চুরনাব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন খরচ হইত পূর্ব পাকিস্তানে।

আপনারা জানেন অর্থ-বিজ্ঞানের কথা। সরকারি আয় জনগণের ব্যয় এবং সরকারি ব্যয় জনগণের আয়। এ নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় হয় ঠিকই, কিন্তু সরকারি ব্যয়ের সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবহিত থাকায় সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিদেশী মিশনসমূহ তাদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই করিতে বাধ্য হইতেছেন। এ ব্যয়ের সাকল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়।

ফলে, প্রতিবছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান আমাদের রাজধানী হইত তবে এ সব খরচ পূর্ব পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানিরা এ পরিমাণে ধণী হইতাম। আপনারা পাকিস্তানিরা ঐ পরিমাণে গরীব হইতেন। তখন আপনারা কি করিতেন?

যেসব দাবী করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার তহমত দিতেছেন সেইসব দাবী আপনার নিজেরাই করিতেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মতো আঠার বছর বসিয়া থাকিতেন না। সেটা করা আপনাদের অন্যায়ও হইত না।

তিন. আপনারা ঐসব দাবী করিলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা কি করিতাম জানেন, আপনাদের সব দাবী মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গালী দিতাম না। কারণ, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ও-সব আপনাদের হক্ পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবী করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতোই আন্তরিক যে, সে অবস্থা হইলে আপনাদের দাবী করিতে হইত না। আপনাদের দাবী করার আগেই আপনাদের হক আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক দাবী করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। কিন্তু আপনারা যে নিজেদের হকের সাথে সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন, আপনাদের লোকে কি বলবে? আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হকটা আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দেই। দৃষ্টান্ত চান? শুনুন তবে:

প্রথম গণ-পরিষদে আমাদের মেম্বার সংখ্যা ছিলো ৪৪; আর আপনাদের ছিলো ২৮। আমারা ইচ্ছা করিলেই গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশরক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারিতাম। তা করি নাই।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাইয়ের দরদ লইয়া আমাদের ৪৪টা আসনের মধ্যে ৬টাতে পূর্বপাকিস্তানিরা ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানি মেম্বর নির্বাচন করিয়াছিলাম।

ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষার দাবী করিয়াছিলাম।

ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।

আপনদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্য উভয় অঞ্চলে সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাসে আমরা সংখ্যাগুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যা-সাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।

চার. সুতরাং পশ্চিমপাকিস্তানি ভাই সাহেবনা, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে-যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিলো, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। যদি পশ্চিমপাকিস্তানে রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবী করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্য সত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোঁকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয়, তার নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম।

সকল ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথক পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতাম। আমরা দেখাইতাম, পূর্বপাকিস্তানি মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্বপাকিস্তানিদের নয়, ছোট-বড় নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানির। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তার সুযোগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা সব অধিকার ও চাকুরি গ্রাস করিতাম না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতেই দিতাম।

আমাদের কটন বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশের ওয়াপদা, আপনাদের ডি.আই.সি, আপনাদের ওয়াপদা, আপনাদের ডি.আই.টি আপনাদের পোর্ট ট্রাষ্ট, আপনাদের রেলওয়ে ইত্যাদির চেয়ারম্যানী আমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করিতে দিতাম। সমস্ত পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে পূর্বপাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। ফলত পূর্বপাকিস্তানিকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এ মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।

এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফ-বোধই পাকিস্তানি দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মদ্যে আছে কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এ প্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বের যোগ্য।

যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাটি দাঁত, দুই হাত, দুই পা; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এ সব জোড়ার দুটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালীন করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের এক অঙ্গ দূর্বল হইলে গোটা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দূর্বল করিতে চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হস্তে সেই দুশমনদের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তারই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট ও শক্তি অপরাজেয় হইবে।

পাকিস্তানের মতো বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হইবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এ মাপকাঠিতে আমার ৬ দফা কর্মসূচির বিচার করিবেন। তা যদি তারা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এ ৬ দফা কর্মসূচির বিচার করিবেন। তা যদি তারা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমর এ ৬ দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবী নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবী।

আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা, আপনার দেখিতেছেন যে, আমার ৬ দফা দাবীতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তি-তর্কসহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তানে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বিরাই এদের কাছে গাল খাইয়াছেন, তাদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোনো ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হককে এরা দেশদ্রোহী বলিয়াছেন।

দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিলো এদেরই হাতে। অতএব দেখা গেলো পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবীর কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল-জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হইয়াছে। মুরুব্বিদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য কবিার মতো মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালোবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে-কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতোটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলিয়া আমি মনে করি না।

মরহুম হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তবে পায়ের তলে বসিয়াই এতোকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাই-বোনেরা, আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেনো তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি-সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।

আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম

শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের মনের কথা কী তা বেশ ভালো করেই বুঝতেন। সেভাবেই তিনি ৬ দফা প্রস্তাব করেছিলেন। কাজেই বাঙ্গালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি এই ৬ দফা দ্রুত অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, কল-কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে এবং অত্যধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আম-জনতা এটাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে।

লেখক: আইনজীবী, রাজনীতিক, গবেষক, মুক্ত সাংবাদিক ও গ্রন্থকার

Share

Advertisement

x

Check Also

লামায় চাম্পাতলী বৌদ্ধ বিহার আগুনে পুড়ে গেছে https://coxview.com/fire-rafiq-16-4-24-1/

লামায় চাম্পাতলী বৌদ্ধ বিহার আগুনে পুড়ে গেছে

  মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; লামা-আলীকদম :পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা পৌরসভার চাম্পাতলী বৌদ্ধ বিহারের চেরাং ঘরে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/