সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / সাম্প্রতিক... / ডিজিটালের ছোঁয়ায় কুঠির শিল্প-পাহাড়ী ছন-মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে

ডিজিটালের ছোঁয়ায় কুঠির শিল্প-পাহাড়ী ছন-মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে

এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও :

ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় কিংবা আধুনিক যুগে কুঠির শিল্প, মাটির তৈরি ও ছনের তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে। তার স্থলে এসে পৌছেছে হরেক রকম প্লাষ্টিক সামগ্রীসহ দালান কোঠা। বেশ কয়েক বছর পূর্বেও কক্সবাজার সদর উপজেলার বৃহত্তর ঈদগাঁওয়ের আনাচে কানাচে হলেও দুই চারটি ছনের ঘর চোখে পড়ত বর্তমানে কয়েকটি ওয়ার্ড মিলেও সবুজ পাহাড়ে ধূসর রঙের ছনের চালার ঘর এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। রোদে চিকচিক করা রূপালি ঢেউটিনের চাল বহুদূর থেকেই জানান দেয় তার অস্তিত্বের কথা। সবুজের ফাঁকে খেলা করে সাদার ঝিকিমিকি। আর হাজার বছরের পরম বন্ধু অভিমানি ‘ছন’ নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে চলেছে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, কম দামে ঢেউটিন পাওয়া যায় বলে বৃহত্তর এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের সর্বত্রই দিন দিন টিনের ঘর বাড়ছে। ফলে নতুন করে ছনের ঘর খুব কম হচ্ছে। তাই গ্রাম থেকে শহর কোথাও আর আগের মত ছনের চাষও হচ্ছে না। এমন চিত্র শুধুমাত্র ঈদগাঁও নয় পর্যটন শহর কক্সবাজারের নানা উপজেলাগুলোতেই দেখা যাচ্ছে।

এদিকে টিনের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে সে ছন গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে গেছে। তবে জেলা সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁও তথা ছয় ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পূর্বের ন্যায় সেই ছনের ঘর তেমনি আর চোখে পড়ে না। দীর্ঘদিন ধরে ছনের চাষ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা দু-বয়োবৃদ্ধ এ প্রতিনিধিকে জানান, গ্রামের ঘরবাড়িতে ছাউনি হিসাবে ছনের ব্যবহার এক সময় খুব বেশি ছিল। এখন সেটির পরিবর্তে ছাউনি হিসেবে টিনের কদর বেড়েছে। যার ফলে আমরা অসহায়ত্ব বরণ করছি। গ্রামীণ জনপদের লোকেরা জ্বালানি এবং গরুমহিষের খাদ্য হিসাবে ছন ব্যবহার করত। কিন্তু কালক্রমে গরীবের ছাউনি সেই ছন হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ছনের উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাহাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করে মাটিকে হালকা খুঁড়ে দিলে ভাল ছন হয়। একই পাহাড়ে ফলদ ও বনজ গাছের পাশাপাশি ছনও হয়। বিভিন্ন কারণে পাহাড় ধ্বংসের কারণে এবং রীতিমত পাহাড় পরিষ্কার না করার কারণে পাহাড়ের ছন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। পর পর দু’বার ছন না কাটলে সেই পাহাড়ে আর ছন হয় না। প্রতি বছর ছন কাটলে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিলে ছনের ভালো উৎপাদন হয়। উচ্চবিত্তরাও শখের বসে পাকা ঘরের চিলে কোটায় ছন ব্যবহার করতো।

ঈদগাঁওয়ের গ্রামগঞ্জের বেশ ক’জন ব্যক্তির মতে, সবখানে টিনের ঘর থাকলেও কিছু কিছু গ্রামের অসহায় পরিবার এখনো তাদের মাটির ঘরের সাথে ছন ধরে রেখেছে। তারা পূর্বের লোকজনের মত রেখে যাওয়া ছনের ছাউনির ঘরে থাকেন এখনো। তবে তাদের মতে, শীত ও গরম উভয় মওসুমে আরামদায়ক ছনের ছাউনির ঘর। ছনের ছাউনির ঘর তৈরির জন্য বেশ কিছু কারিগর ছিল। এখন তাও হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলা থেকে। বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে ছাউনি দেয়া হতো। ছাউনির উপরে বাঁশ ও বেত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে পানি ছিটানো হতো। যাতে করে সহজে ছনগুলো বাঁশের উপর বসে যায়।

এক সময়ের ছন চাষী এক ব্যক্তির মতে, কমশ্রমে বেশিলাভ থাকলেও এখন আর ছন চাষে আগ্রহী না চাষীরা। কারণ আধুনিকায়নের সাথে সাথে এখন ছনের চাহিদা কমে গেছে। কারণ মানুষ এখন আর বাঁশ ও ছন দিয়ে ঘর তৈরি করতে চায় না। বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো বেশি দিন টেকসইও হয় না। যার কারণে ছনের চেয়ে বেশি চাহিদা বেড়েছে এখন টিনের। তাই ছনের ঘর দখল করে নিয়েছে টিনের ঘরে। গ্রাম থেকে শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকাজুড়ে দেখা মিলে ছনের পরিবর্তে ছোট বড় অসংখ্য টিনের ঘর। হারিয়ে যাচ্ছে তাই ছনের ব্যবহার। আধুনিক সভ্যতায় মানুষ এখন পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে টিনকে। আর তার স্থলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলা থেকে সে ছনের।

অন্যদিকে জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কুঠির শিল্প বিলুপ্তির পথে, বর্তমান সময়ে প্লাষ্টিক শিল্পের প্রতি কদর বাড়ছে গ্রামাঞ্চলের লোকজনের। তার পাশাপাশি বাঁশ ও বেতের তৈরি কুঠির শিল্প জাতীয় দ্রব্য হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। বাজারে হরেক রকম কোম্পানীর প্লাষ্টিকের জিনিসপত্রের কদর বাড়ায় ও প্রয়োজনীয় পূঁজির অভাবে বাঁশ ও বেতের তৈরি কুঠির শিল্পের কারিগরদের মাঝে চলছে দুর্দিন। কিন্তু কালের আবর্তে কুঠির শিল্প সামগ্রীর চাহিদা কমতে থাকা, বাঁশ ও বেতের চড়া দাম, ঋণের ভার ও দাদন তাদের অন্যরকম ব্যাথা হয়ে দাড়িয়েছে।

জানা যায়, জেলার আট উপজেলা তথা পেকুয়া, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাঁশ ও বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু পরিবার কোন রকম বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিতে দেখা যায়। জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বহু পুরাতন আমলের লোকজন বাঁশ ও বেত শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে প্রয়োজনীয় ঋণ, পূঁজি ও তাদের ন্যায্য মজুরী কম থাকার ফলে তারা নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি গ্রাম থেকে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। এ শিল্পের সাথে জড়িত অনেক শ্রমিক বলতে গেলে প্রায়ই বেকার জীবন যাপন করছে। গ্রামের ঘরে এখন আর এগুলো পূর্বের ন্যায় চোখে পড়ে না। অথচ একদিন গ্রাম ছাড়া বাঁশ আর বেতের জিনিস কিংবা এসব ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিন ছিল। ঠিক এ কুঠির শিল্পকে পেছনে ফেলে বর্তমানে আধুনিক কিংবা ডিজিটাল যুগে সভ্যতার ক্রমবিকাশ পরিবর্তনের ফলে প্লাষ্টিক শিল্পের কদর এবং জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। এখন অজপাড়াগায়ের লোকজনও বাঁশ ও বেতের নির্মানাধীন কুঠির শিল্পের প্রতি বিমুখ হয়ে প্লাষ্টিক শিল্পের দিকে নজর দিচ্ছে।

দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নের যুগে আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে জেলার প্রত্যন্ত উপজেলার লোকজন আজ প্লাষ্টিক শিল্পের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। পূর্বে গ্রামের লোকজন শীতের সকালে মিষ্টি রোধে ৬/৭ জন একত্রিত হয়ে বাঁশ ও বেতের সাহায্যে তৈরি করত নানা রকম ব্যবহার্য সামগ্রী। এমনকি জীবিকা উপার্জনের অন্যতম পথ ছিল বাঁশ ও বেত। পূর্বে জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রাম-গঞ্জে এক সময় ব্যাপক বাঁশের চাষ করা হত। জলাশয় কিংবা পুকুর পাড়ে জন্ম নিত বেত। আজ কালের আবর্তে সেই পুরনো আমলের বাঁশ ও বেতের বাগান বিলীন হতে চলছে। সে সাথে কারিগরেরাও মাথায় হাত দিয়েছে। পূর্বে গ্রামের নারী-পুরুষ তাদের নিপুঁন হাতের তৈরি ক‚লা, চাটাই, হাঁস-মুরগীর খাচা, ঢাকনা, চালনি, মুড়া বেতের ধামা, পাতিল, চেয়ার, টেবিল, দোলনা, পাখা, বই রাখার রেক, ডালা, ঝুড়ি ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় শিল্প সামগ্রী জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলার বাজারেও বিক্রি করা হতো। বর্তমানে এসব কিছু হারিয়ে ডিজিটাল যুগের লোকজন প্লাষ্টিক পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে করে জেলা থেকে একের পর এক বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে বাঁশ ও বেত শিল্প।

আবার সবুজ-শ্যামল ছায়াঘেরা শান্তির নীড় মাটির ঘর। বেশিদিন দুরের কথা নয়, প্রতিটি গ্রামে একসময় নজর কাড়তো সুন্দর মাটির ঘর। যাকে গ্রামের মানুষ বলেন, গরীবের এসি ঘর। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাচাঁর পাশাপাশি প্রচুর গরম ও খুবই শীতে বসবাস উপযোগী মাটির তৈরি এসব ঘর এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। আধুনিকতায় ছোঁয়া আর কালের আবর্তে বৃহত্তর ঈদগাঁওয়ের নানা গ্রামে এ চিরচেনা মাটির ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। অতীতে মাটির ঘর গরীবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল। এ ঘর শীত ও গরম মওসুমে আরামদায়ক তাই আরামের জন্য গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি অনেক বিত্তবান ও মাটির ঘর তৈরি করে থাকতেন। জানা যায়, বৃহত্তর এলাকার নানা গ্রামগঞ্জে প্রাচীনকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল।

এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিনত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হত। ১০-১৫ ফুট উচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় থড় অথবা টিনের ছাউনি দেয়া হত। মাটির ঘর অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। সব ঘর বড় মাপের হয় না। গৃহিনীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা একে তাদের নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তুলতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মওসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট- সিমেন্টের ঘর নির্মানে এখন উৎসাহী হচ্ছে গ্রামগঞ্জের মানুষজনও। এক সময় উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। তবে বর্ষণে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বেশি। ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির ঘর শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু কালের আবর্তে দালান-কোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানছে সে চিরচেনা মাটির ঘর।

ঈদগাওয়ের মাছুয়াখালী, কালিরছড়ার বেশ ক’জন বয়োবৃদ্ধরা জানান, দীর্ঘ বছর পূর্বে আমরা অনেক কষ্টের বিনিময়ে মাটির ঘর নির্মাণ করেছিলাম। যার কারণ এসব ঘর শীত ও গরম উভয় মৌসুমে আরাম দায়কভাবে বসবাস করা যেত। এখন ডিজিটাল যুগে ছেলেমেয়েরা আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির ঘরের পরিবর্তে গ্রামগঞ্জে দালানকোঠা মুখি হতে দেখা যাচ্ছে বলে জানান। একই এলাকার সত্তরোর্ধ্ব অপর এক বৃদ্ধার মতে, একটি এলাকাজুড়ে খুঁজলে হয়ত ২/১টা মাটির ঘর পাওয়া মুসকিল হয়ে পড়বে। যা আছে তাও জরাজীর্ণ। তার স্থলে দালান নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানান। এমনকি মাটির ঘর বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের পরিবর্তনে আধুনিকতার সময় অধিকাংশই মানুষ মাটির ঘর ভেঙ্গে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প জায়গায় অনেক লোকের নিবাসকল্পে ইটের ঘর তৈরিতে মনোনিবেশ করেছেন মানুষ।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

ঈদগাঁওর সংবাদকর্মী আবু হেনা সাগরের মাতা অসুস্থ : দোয়া কামনা 

  বার্তা পরিবেশক : কক্সবাজারে ঈদগাঁও উপজেলার সংবাদকর্মী এম আবুহেনা সাগরের মাতা অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের ইবনে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/