Home / প্রচ্ছদ / কলাম / নৃ-গোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা ও পরিচিতি

নৃ-গোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা ও পরিচিতি

chakma life history 08.06.16 2pic (3)

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় সর্ববৃহত্। চাকমা সমাজে নিজেদেরকে বলে চাঙমা। বিভিন্ন উপজাতি নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা চাকমাদেরকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল বা তিন পার্বত্য জেলা তথা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় চাকমা সম্প্রদায় বসবাস করে। বর্তমানে জীবন জীবিকার কারণে সারা দেশে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করে। চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক গুথি বা গোত্র এবং গঝা বা গোষ্ঠী রয়েছে। এই সংখ্যা ৩২টির মত হবে।

পটভূমি :

চাকমা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। আগের প্রথা অনুযায়ী গর্ভবতী মহিলাকে নিজের স্বামীর ঘরে বা স্বামীর গোষ্ঠীর ঘরে সন্তান প্রসব করতে হত। এখন ঐ নিয়ম নেই। পূর্বে ওঝারাই নামক ধাত্রী গর্ভবতী নারীদের সন্তান প্রসব করাতেন। চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে নবজাত শিশুর নাভি (ন্যেয়) ছিড়ে যাওয়ার পর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ‘কোজই পানি লনা’ নামক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ওঝা ডেকে ঘিলে কোজোই (পরিশুদ্ধ) পানি দিয়ে নবজাত শিশুর চুল ধুয়ে পবিত্র করা হয়। কোজই পানি লনা অনুষ্ঠানে সীমিত আকারে ঘনিষ্ঠ গন্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়। ওঝারাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হলে উক্ত অনুষ্ঠানে ওঝাকে পুরষ্কৃত করা হয়।

সমাজ ব্যবস্থা :

চাকমা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের সার্কেলের প্রধানকে রাজা বলে। রাজা তাদের প্রথা, রীতি, নীতি, ভূমি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, পার্বত্য জেলা পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেয়া, কার্বারী নিয়োগ, হেডম্যান নিয়োগের মত কাজ করে থাকে। গ্রামের কার্বারী যাবতীয় ঝগড়া, নানা সমস্যার নিস্পত্তি করে থাকেন। হেডম্যানরা অনেক কাজ করলে ও মূল কাজ খাজনা তোলা। আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতে চাকমারা নেতৃত্বধর্মী ভূমিকা পালন করে আসছে বৃটিশ অথবা পাকিস্তান আমল থেকেই। চাকমা রাজা নাম দেবাশীষ রায়।

স্বীকৃতি ও প্রশাসনিক অবস্থান :

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ঠ্যের আলোকে তত্কালীন সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন এবং তারঁ নেতৃত্বে পার্বত্র চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগোষ্ঠীর আন্দোলন গড়ে গঠে। যে আন্দোলন বর্তমানে স্তিমিত। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি মোতাবেক এই আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য উপজাতিদের মত চাকমাদের ও আঞ্চলিক এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে আসন সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে ৫টি সাধারণ এবং ১টি মহিলা আসন চাকমাদের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে যথাক্রমে ১০টি, ৯টি ও ১টি আসন সংরক্ষিত আছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চাকমাদের মধ্যে থেকে মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালনের নজির লক্ষ্য করা যায়। তিন পার্বত্য জেলায় পৌরসভা গুলোতেও চাকমা জনগোষ্ঠী থেকে অনেকে চেয়ারম্যান পদে এবং কমিশনার পদে নির্বাচিত হয়েছে।

পোশাক ও অলংকার :

চাকমা নারীরা বেইন নামের এক প্রকার কোমর তাতেঁ কাপড় তৈরী করে। নারীদের পোশাকের মধ্যে আছে পিনন, খাদি বক্ষ, কাগই, পাগড়ি, আলাম (নকশার নমুনা)। এক্ষেত্রে আলাম কোন পোশাক নয় নানা রং ও ডিজাইনের ফুলে বোনা একটি কাপড়। বুননের সরঞ্জামকে তারা সজপদও বলে। চাকমা মহিলারা সোনা, রুপা ও হাতির দাঁতের তৈরি হাঁসুলি, চন্দ্রাহার, মুদ্রামালা, নেকলেস, বালার মত অলঙ্কার পরে। নাকে পরেন নাগফুল।

খাবার :

তারা তৈজসপত্র হিসেবে কাঠ, বাঁশ পাকা ফলমুলের জিনিস ব্যবহার করে। এছাড়া (হুক্কা) দাবা, ফুনি, কুলো, বিজোন, মজরার মত তৈজসপত্র ব্যবহার করে। কলাপাতা বা আগুনে পুড়িয়ে যে তরকারি তারা খায় তা কেবাং। বাঁশ দিয়ে রান্না করা খাদ্যকে তারা গরাঙ বলে। প্রচুর মরিচ, পেয়াঁজ, শুঁটকি মিশ্রিত খাবারকে তারা কোরবো বলে। তারা শুটঁকি, চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ করে। ফুজি নামক একপ্রকার মশলা তাদের খুব পছন্দ। সিক্যা হচ্ছে লবণ মরিচ হলুদ মিশিয়ে বিভিন্ন মাংসখন্ড আগুনে সেকেঁ খাওয়া যা তারা খায়।

ধর্ম ও বিশ্বাস :

চাকমা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও এখনও প্রকৃতি ভুত, প্রেত, দেবতা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস আছে। চাকমা সম্প্রদায় কঠিন চীবর দান, মাঘী পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্নিমা, মধু পূর্ণিমা, ফানুস ওড়ানো, গাড়ি টানা, হাজার বাতি প্রজ্জ্বলন করা, মহাসংঘ দান, ব্যুহ চক্র প্রভৃতি অনুষ্ঠান ধুমধাম সহকারে পালন করে। চাকমা সহ সকল উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে।

বিবাহ ও শিক্ষা :

তবে চাকমাদের মধ্যে অনেক চাকরিজীবি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফরেষ্ট ভিলেজার, মত্স্যজীবি রয়েছে। চাকমা সমাজে পুত্ররা পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার। ছেলেদের বর্তমানে কন্যা সন্তান কেবলমাত্র বিয়ের কাল পর্যন্ত ভরনপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখে। উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সাক্ষরতার হার বেশী চাকমা সম্প্রদায়ে।

চাষাবাদ :

চাকমা সমাজ কৃষি নির্ভর সমাজ। চাকমা সম্প্রদায় বহু সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান খুব জাকজমকের সাথে পালন করে। এর মধ্যে হাল পালনি অনুষ্ঠানে আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে মা লক্ষীকে ফসল ভাল হওয়ার জন্যে থালায় মুরগি, ভাত, ডিম দেয়া হয়। মালেইয়া উত্সবে জুমচাষের জন্যে, জঙ্গলকাটা, জুমের ধান কাটার জন্যে বহু গৃহস্থ গ্রামবাসীর সাহায্য কামনা করে। যারা সহযোগিতা করতে আসে তাদের কোন মজুরি দিতে হয় না, কাজের শেষে ভালো ভোজের আয়োজন করা হয়।

chakma life history 08.06.16 2pic (2)

কৃষ্টি-সংস্কৃতিঃ

চাকমা সমাজে কোন প্রসূতি সস্তান প্রসব করলে আত্মীয়রা ভাত, মাংস, মাছ, শুঁটকি, ডিম, নানা তরকারি কলাপাতায় মুড়িয়ে দেয় যাতে প্রসূতি, নবজাতকের স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এই প্রথাকে ভাত মঝা দেনা বলে। তারা বিজু উত্সব ৩দিন ধরে পালন করে। যা ফুল বিজু, মুল বিজু এবং নুতন বছরের গোজ্যাপোজ্যা দিন হিসেবে পরিচিত। বিজুর দিন শিশু, কিশোর, তরুণ বয়সীরা বন থেকে ফুল এনে বাড়ি সাজায়। বুদ্ধের উদ্দেশ্যে ফুল দেয়, সকাল বেলায় বিভিন্ন বাড়িতে গৃহপালিত প্রাণীদেরকে ফুল দেয়। মূল বিজুতে ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। ঐতিহ্যবাহী পিঠা, তাজা ফলমুল, বিভিন্ন সেদ্ধ আলুসহ, মদ ইত্যাদি। বিশেষ ৫ ধরনের সব্জি দিয়ে পাজন তৈরি করা হয়। অনেক সময় ১০০ পদের ও বেশী সব্জি দিয়ে শুঁটকি বা শুকনো মাছ মিশ্রিত করে পাজন তৈরি হয়। অবশ্য বর্তমানে শহরাঞ্চলে বাঙালীদের মত আধুনিক খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এই দিন ঘরের বৃদ্ধদেরকে যুবা বয়সীরা গোসল করায়। সন্ধ্যায় মোমবাতি নিয়ে, নদীকে পূজা করা হয়। এই দিন মুলত: পুরোনো বছরের ময়লা আবর্জনা মুছে পুত পবিত্রতার প্রতীক। গোজ্যাপোজ্যার দিন বাড়িতে ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ করে মঙ্গলসূত্র শোনে, কিয়াঙে বা উপাসনালয়ে যায়, বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। রাজপুণ্যা হতে চাকমা রাজা নিজে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি একটি গণ-অনুষ্ঠান যখন হেডম্যানরা তাদের রাজার কাছে কর প্রদান করেন। এই দিন মেলা বসে, বিনোদনমূলক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদ্বি হয়, সাধারন মানুষের জন্য বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকে। পূর্বে চাকমারা এই অনুষ্ঠানটি খুব জাকজমকের সাথে পালন করত। চাকমা সমাজে নারীদের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে অংশগ্রহনের হার পুরুষের চেয়ে কম। ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।

মৃত্যু ও শেষকার্য সম্পাদন :

চাকমা সমাজে কারো মৃত্যু হলে বিশেষ ঢোল বাজায় যাতে মানুষ বোঝে কেউ মারা গেছে। গৃহস্থেরা খবর নেয়, গৃহিনীরা গৃহের সদর দরজায় মাটির বারকোষ বা অন্য পাত্রে তুষ দিয়ে আগুন জালিয়ে রাখে। যাতে ভুতপ্রেত না আসে। শবদাহের দিন মরদেহ স্নান করানো হয়, মঙ্গলসূত্র পাঠ করা হয়। ঘাট পারের বাড়া হিসেবে মৃতের সাথে টাকা পয়সা দিয়ে দেয়া হয়। মৃতদেহটি পুরুষ হলে শব রাখার আলোংঘর সহ চিতার চারিদিকে ৫বার ও শবদেহটি মহিলার হলে চিতার চারিদিকে ৭বার ঘোরানো হয়। পরে মৃত্যের বড়ছেলে বা রক্ত সর্ম্পকীয় আত্মীয় প্রথম চিতায় আগুন দেয়।

লেখক:

নিজস্ব প্রতিনিধি, লামা

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

৫ জানুয়ারি; ইতিহাসের এইদিনে https://coxview.com/poet-sukumar-barua-birth-day/

৫ জানুয়ারি; ইতিহাসের এইদিনে

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে জন্ম ১৯৩৮ সালের ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/