সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / ভ্রমণ ও পর্যটন / মাথিনের কূপ ও মাথিনের প্রেম

মাথিনের কূপ ও মাথিনের প্রেম

নিজস্ব প্রতিবেদক :
অমর প্রেমের নিদর্শন মাথিনের কূপ। এই কূপের পেছনে রয়েছে একটি মর্মান্তিক প্রেমকাহিনী। একটি মিষ্টি প্রেমের সত্য গল্প। যুগ যুগ ধরে সেই প্রেমগাথা নিয়ে রচিত হতে শুরু করলো অজস্র গীতিনাট্য, কাব্য, উপন্যাস। বেদনাবিধুর প্রেমের বহুল আলোচিত সেই ঘটনার কালজয়ী সাক্ষী টেকনাফের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। এটি মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। কেউ কেউ সঠিক মানুষটিকে খুঁঝে পায় জীবনে, বাকিটা সময় স্বপ্নের ভূবনে ঘুরে ফিরে কেটে যায়। কিন্তু সব ভালোবাসা জীবনে শুভ পরিণতি পায় না।

দেশের দখিণা জেলা কক্সবাজারের সীমান্ত শহর টেকনাফ উপজেলা। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানা-অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি। টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে ছিল বিশাল এই পানির কূপ (পাতকুয়া)। পুরো টেকনাফ জুড়ে এটিই ছিল একমাত্র পাতকুয়া। এই কূপেই সুপেয় পানির জন্য রোজ ভিড় জমাত স্থানীয়রা। প্রতিদিন ভোরে কলসি নিয়ে সখিদের সঙ্গে পানি নিতে আসতো আশপাশের রাখাইন যুবতীরাও। একদিন মগী রাখাইন তরণীদের হাসি গল্প আর অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। রং-বেরংয়ের পোষাক পড়ে পাতকুয়া থেকে কলসী হাতে পানি নিতে আসা এসব সুন্দরী রাখাইন যুবতীর মৃদুকন্ঠে ভেসে আসা সুরলা মধুর গান শুনে মুগ্ধ হতো দারোগা ধীরাজ। থানায় তার তেমন কোন কাজ কর্ম ছিলনা। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে কাটাতেন ধীরাজ। আর থানার ছোট বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য তন্ময় হয়ে দেখতেন। শুধু তাই নয় সেখানে ১৪/১৫ বছর বয়সী সুন্দরী রাখাইন কন্যারা বেশ ভালই আড্ডা জমাতো। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে, সুন্দরী এই তরুণীর নাক, চোখ, মুখ অবিকল বাঙালি মেয়েদের মতো।

একদিন-দুদিন এভাবে দিন গড়াতে থাকে। দেখাদেখি-হাসাহাসি চলতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের মাঝে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো। সময়ে সে সখ্যতা প্রেমে পরিণত হয়েছিলো। দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। সম্ভব অসম্ভব নানা জল্পনা কল্পনার স্বপ্ন জালে আবদ্ধ হয় ধীরাজ ও মাথিন।

মাথিন ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় রাখাইন জমিদার ওয়াং থিনের একমাত্র রূপবতী কন্যা আর সুদর্শন ধীরাজ ভট্টাচার্য্য ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। দারোগা হিসেবে সুদূর কলকাতা থেকে টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। কলকাতা থেকে দুর্গম টেকনাফে আসা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। শিলাইদহ থেকে গোয়ালন্দ প্রথমে ট্রেনে, তারপর গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত স্টিমারে। সেখান থেকে স্টিম ইঞ্জিন ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামের বাটালি স্টেশন।

ইতোমধ্যে দু’জনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম—একজন হিন্দু, অপরজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। নানা বাধা সত্ত্বেও এক সময় নিজেরা বিয়ের জন্যও প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সমাজের আচারের বাইরে যেতে রাজি ছিলেন না মাথিন। বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েই নিজস্ব রীতিতে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন তারা। এর সূত্র ধরেই নানা বাধাসত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ে কথা পাকাপাকিও হয়। সব ঠিক ছিল। বিয়ের ক্ষণও ঘনিয়ে এসেছিল। যখন সব ঠিকঠাক বিয়ের ক্ষণ গোনাতেও বাকি নেই বেশি দিন, তখনই অযাচিত বাধা আসে। দ্রুত ফিরে এসে মাথিনকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেন।

হঠাৎ একদিন দারোগা ধীরাজের কাছে ব্রাহ্মণ পিতার জরুরি টেলিবার্তা আসে। যেখানে তার বাবা লিখেছিলেন খুব জরুরিভাবে তাকে কলকাতা যেতে হবে। এক মাসের ছুটি নিয়ে হলেও ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছাড়ে পালিয়ে গেলেন। ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হলো, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছে।

এদিকে ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। ধীরাজের অপেক্ষায় দিন গুণতে গুণতে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন মাথিন। প্রতিদিন থানার বারান্দায় গিয়ে সেই কূপের পাশে দাঁড়িয়ে ধীরাজের ফিরে আসার অপেক্ষা করতো আর কাঁদতো। সে সময়ে যোগাযোগ ব্যাবস্থাও এতটা উন্নত ছিলোনা যে সে ধীরাজের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় বের করবে। দিনে দিনে মাথিনের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছিলো। প্রাণপুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন-জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়াথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শতো চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্ন-জল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এককথা-ধীরাজকে চাই। কোন ডাক্তার-কবিরাজ মাথিনকে আর সুস্থ করতে পারেনি। ফিরানো যায়নি স্বাভাবিক জীবনে। প্রেমের এই বিচ্ছেদে এবং অতিকষ্টে ধীরে ধীরে মাথিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো। সেই থেকে এই পাতকুয়াটির নামকরণ “মাথিনের কূপ”।

কূপটি ঘিরে রাখাইন সম্প্রদায়ের জমিদার কন্যা মাথিন আর পুলিশ অফিসার ধীরাজ ভট্টাচার্যের হৃদয়বিদারক প্রেমকাহিনী এখনও জীবন্ত। একদিকে প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে অনিদ্রা আর অনাহারে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে পুলিশ অফিসার ধীরাজ ভট্টাচার্যের পিতার অসুস্থাজনিত কারণে গোপনে চলে যাওয়া। বিষয়টি অমর হয়ে আছে এক বেদনাবিধুর প্রেম কাহিনী। প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষার অনন্য এক নিদর্শন এই প্রেম। প্রাণপ্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে এতটুকু দ্বিধাগ্রস্ত হননি।

পরবর্তীকালে তাঁদের অমর প্রেমের আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসেবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জায়গাটি সংরক্ষণ করে একটিকে মাথিনের কূপ হিসেবে নামকরণ করেন। মনোমুগ্ধকর করে তৈরি করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আনন্দ দিতে স্থানটিকে বাহারি ফুলবাগান দিয়ে সাজানো হয়েছে। পর্যটকদের জন্য করা হয়েছে টি স্টল, বাহারি ফুলের বাগান, বিশ্রামাগারসহ নানা স্পট। সেইসঙ্গে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। সব মিলিয়ে অপূর্ব একটি পর্যটন স্পট।

ধীরাজ ভট্টাচার্য
যশোর জেলাস্থ কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে ১৯০৫ সালে এক শিশু জন্মগ্রহণ করেন। নাম তার রাখা হয় ধীরাজ। তার পিতা ছিলেন ললিতমোহন ভট্টাচার্য, পেশায় একজন শিক্ষক। দুর্গাপূজোর সময় গ্রামের ছেলেদের সাথে নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি দু’শ ছায়াছবিতে এবং পঞ্চাশটির মতো নাটকে অভিনয় করেছেন ।

কর্মজীবনের শুরুটা হয় একটি নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটি ১৯২৪ সালে নির্মিত হয়। যার চিত্র পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ তার পরিবার মেনে নেয়নি। ফলে চলচ্চিত্র তাকে ছাড়তে হয়। এবং বাবার কথায় ভর্তি হন পুলিশের কলকাতা জোনের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে। তারপর তার বদলি হয় বার্মায়। কিন্তু কিছু অসুবিধার কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়। ১৯২৩-১৯২৪ সালের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে কর্মরত ছিলেন তিনি।

টেকনাফ ত্যাগের পর পুলিশের চাকরি ছেড়ে ১৯২৫ সালে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। আবার কলকাতায় ফিরে তিনি সিনেমায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করেন। তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘সতীলক্ষী’। এছাড়াও তার অভিনীত কিছু নির্বাক চলচ্চত্রি হলোঃ- ১৯২৯ সালে ‘গিরিবালা’, ১৯৩০ সালে ‘কাল পরিণয়’ ও ‘মৃণালীনী’ এবং ১৯৩২ সালে ‘নৌকাডুবি’ সহ ৫৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন ধীরাজ।

এই সবাক যুগে এসে ধীরাজের প্রথম ছবি হলো কৃষ্ণকান্তের উইল। আরো কিছু সবাক চলচ্চিত্রঃ- যমুনা পুলিন, দক্ষযক্ষ, বসনত্মসেনা, নরনারায়ণ, কৃষ্ণসুদামা, মরণের পরে, হানাবাড়ী, রাত একটা, ডাকিনলার চর, ধূমকেতু। ১৯৫৮ সালে তার অভিনীত শেষ সিনেমাটি মুক্তি পায়, ছবিটির নাম ‘নীলাকঙ্গা’।

সাহিত্যে ধীরাজের আগ্রহ ছিল। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি লিখেছেন দুটি আত্মাজীবনীমূলক গ্রন্থ। গ্রন্থদুটি হচ্ছে একটি যখন নায়ক ছিলাম এবং যখন পুলিশ ছিলাম। এছাড়া তার আরো কিছু গ্রন্থ রয়েছে। যেমনঃ মন নিয়ে খেলা, সাজানো বাগান, মহুয়া মিলন ইত্যাদি।

এই জনপ্রিয় অভিনেতা ১৯৫৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনে তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

যেভাবে যাবেন
কক্সবাজার আসতে বিভিন্ন ধরণের এসি-নন এসি বাস সার্ভিস রয়েছে। এদের মধ্যে সৗদিয়া, এস আলম, গ্রিন লাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, এস.আলম পরিবহন, সেন্টমার্টিন হুন্দাই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

ঢাকা থেকে বাসে যেতে চাইলে গাবতলী, শ্যামলী, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে বাস পাবেন। অথবা ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গিয়ে তারপর বাসে করে কক্সবাজারে যেতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার ভ্রমণ করতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলস্টেশন হতে সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা-নিশীথা, মহানগর প্রভাতী/গোধূলী, চট্টগ্রাম মেইলে করে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন এ নেমে সেখান থেকে বাসে করে কক্সবাজার।

এছাড়া বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা, ইউনাইটেড এয়ার ওয়েজসহ বেশকিছু বিমান ঢাকা থেকে কক্সবাজার ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।

ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফের বাস আছে। এসি বা ননএসি দুই ধরনের বাস পাওয়া যায়। ভাড়ায় পাওয়া যাবে রেন্ট-এ-কার এর গাড়ি। এছাড়াও কক্সবাজার থেকে অনেক বাস সার্ভিস আছে। ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার ভিতরে আপনি চলে আসবেন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফে। বাস থেকে নেমে হেঁটে অথবা রিকশায় টেকনাফ শহরের প্রাণকেন্দ্রে নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্তরে এই মাথিনের কূপ। সেই ঘটনার কালজয়ী সাক্ষী ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। যা এখনও আকর্ষণীয় হয়ে আছে সীমান্ত উপজেলার টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে।

কোথায় থাকবেন
টেকনাফে থাকার মতো অনেক হোটেল ও রিসোর্ট আছে। যার মধ্যে হোটেল নাফ ও হিলটপ, নেটং ও সেন্ট্রাল রিসোর্টে রুম পাওয়া যাবে। এছাড়াও টেকনাফে খাবারের জন্য অনেক রেস্টুরেন্ট আছে।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

https://coxview.com/wp-content/uploads/2023/04/Thermometer-Hit-Hot.jpg

বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই, রাতে বাড়বে গরম

অনলাইন ডেস্ক : ঢাকাসহ দেশের কোনো বিভাগেই বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/