সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / শিক্ষা-দিক্ষা / মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাঃ প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষা

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাঃ প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষা

আশীষ কুমার দত্ত মিন্টু

মাতৃভাষা অর্থ মায়ের ভাষা। জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে বা পরিবারে সবার সাথে বেড়ে ওঠার সময় শিশুরা যে ভাষা শিখে তা-ই তার মাতৃভাষা। দেশের ও মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতি বা কল্যাণ সাধন একমাত্র ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব। ভাষার মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করি আমাদের অভিজ্ঞতা, নানা ধরনের আবেগ, বিভিন্ন প্রকার অনুভূতি যেমন- হিংসা-বিদ্বেষ, ভালোলাগা ও ভালবাসা, ঘৃণা, ক্ষোভ ইত্যাদি।

প্রাথমিক শিক্ষা সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের। জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে গড়ে তোলার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য জাতিসত্ত্বা, আত্মসামাজিক, শারীরিক, মানসিক, সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্মত উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য।

যে সব আদিবাসী শিশু প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে, যারা বাংলা একেবারেই বোঝে না বা খুব কম বোঝে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষার একটা ভূমিকা থাকবে, এটাই কাম্য। প্রত্যাশিত যে, শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হবে। নীতিগতভাবে মাতৃভাষা শিক্ষা অধিকার সকল শিশুরই রয়েছে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনেও এটিই কেবল একমাত্র পদ্ধতি।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর ১৮, ১৯, ২০ অনুচ্ছেদে আদিবাসী শিশু শিক্ষা নিশ্চিত কল্পে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অনুচ্ছেদে ১৮-এ বলা হয়েছে ‘‘আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। এই কাজে বিশেষ করে পাঠ্য পুস্তকের প্রনয়ণে, আদিবাসী সমাজকে সম্পৃক্ত করা হবে।

জাতীয় শিক্ষা আইন-২০১৬ এর ৫ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে- “সরকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পর্যায়ক্রমে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে স্ব-স্ব মাতৃভাষার শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করিবে।” আমরা ধরে নিতে পারি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী বলা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭-এ {(ধারা ৩৩ (খ) (২)}, ১৯৯৮

সনে গৃহীত রাঙ্গামাটি ঘোষণাপত্রে স্ব-স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে (রাঙ্গামাটি ঘোষণাপত্র, ১৯৯৮; শিক্ষা: ৫৩)। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে (২০০৫) আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিশুদের জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (চজঝচ ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৫২-৫৩)। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ১৯৯৮ সালে ২২নং তপশীলে ৩নং শিক্ষার অনুচ্ছেদের এনসিটিবি বইয়ের পাঠদান মাতৃভাষায় করার সিদ্ধান্ত হয় কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি যা প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে।

২০১৩ সালের শুরুতেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয় এবং প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও বিষয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গঠিত হয় একটি জাতীয় কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশে প্রাথমিকভাবে ছয়টি (চাকমা, মারমা, ককবোরক, মান্দি, সাঁওতালি ও সাদরি) ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া চলছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ১১টি পৃথক ভাষাভাষী ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। জনগোষ্ঠীর দৃ-একটির মাত্র সম্পূর্ণ লিপি বা হরফ আছে। আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা, মারমা, মনিপুরী ও ম্রোদের শিক্ষা লিপি যা দ্বারা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে উন্নয়ন কিছু কিছু উন্নয়ন সংস্থা মাতৃভাষা ভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সাঁওতালেরা তাদের ভাষায় রোমান লিপি ব্যবহার করে আসছে ১০০ বছরের অধিক। এ ছাড়া বাংলাদেশে তারা বাংলা লিপিও ব্যবহার করে থাকে। মন্ত্রণালয়ে গঠিত আদিবাসীদের মাতৃভাষা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি লিপির প্রশ্নে কোন জনগোষ্ঠী কোন লিপি ব্যবহার করবে, তা সম্পূর্ণ তাদের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।

এ ক্ষেত্রে নিজ নিজ ভাষার ওপর তাদের যে মমতা ও আবেগ রয়েছে, তা যেন বিদ্যমান থাকে একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় ঐতিহ্যের এই দেশে তা রক্ষা করার চেষ্টা করছে কমিটি। যাদের লিপি তারা রোমান অথবা বাংলা যে হরফেই হোক না কেন, এটি নির্ধারণ করবে নিজ নিজ ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী।

সূচনাবর্ষে (২০১৪/১৫) পাঁচটি আদিবাসী ভাষা এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরও কিছু ভাষা এভাবে ক্রমান্বয়ে সম্ভাব্য সব আদিবাসীয় মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সম্পন্ন করা হবে। প্রাথমিক সমাপনী বা পঞ্চম শ্রেণিতে যাওয়ার আগে ভাষিক সমন্বয় (ব্রিজিং) অর্থাৎ মাতৃভাষা থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখা এবং বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা লাভের যোগ্যতা অর্জন করার প্রক্রিয়াটি আনুষ্ঠানিক MLE (Multi Level Education) ব্রিজিং প্রক্রিয়া মেনেই করা হয়েছে।

মাতৃভাষা ভিত্তিক শিক্ষা নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগকে গভীরতর করার পাশাপাশি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিও শ্রদ্ধা নির্মাণে সহায়তা করে। কারণ এ ধরণের ব্রিজিং প্রক্রিয়ার (নিজের মাতৃষাভা থেকে ক্রমান্বয়ে দেশের প্রধান ভাষায় উত্তোরণের প্রক্রিয়া) মধ্য দিয়েই পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে যেমন নিজেদের চেতনায় ধারণে সক্ষম হয়। তেমনি অপরাপর ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও তারা ইতিবাচক কিছু শিখতে ও জানতে পারে যা তাদের চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে।

পরিশেষে, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রয়োজন সরকারের সদ্বিচ্ছা। মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠদান নিশ্চিত করণে আদিবাসীদের নিজ নিজ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরির মাধ্যমে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করলে আশা করা যায় অতি শীঘ্রই এ পদক্ষেপটি আলোর মুখ দেখবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিসত্তার ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে তাদের জীবনের পাঠ শুরু করবে এ প্রত্যাশা করি।

“মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাঃ প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষা,”- এ বিষয়েকিছু সুপারিশঃ-

১। আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি একাডেমী স্থাপন।
২। মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় আর্থিক বরাদ্দ প্রদান।
৩। ১৯৫৩ সালে ভাষার সমান মর্যাদা প্রশ্নে ‘ঙ’ নম্বর ধারার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
৪। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক স্তরে আদিবাসী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা।
৫। প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা।
৬। সরকারি ও বেসরকারি সকল আদিবাসী সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

(আশীষ কুমার দত্ত মিন্টু)
প্রধান শিক্ষক, মেরাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
লামা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

গোমাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১শের আলোচনা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত

এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও : কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার উপকূলীয় এলাকার শিক্ষাঙ্গন গোমাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/