সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / কলাম / সাদা টিয়ে পাড়া

সাদা টিয়ে পাড়া

Moung Ba Aung (Moung Ba) -: মং বা অং (মংবা) :-

এক গ্রামে এক গরীব কৃষক পরিবার বাস করত। মা-বাবা এবং দশ বছরের ছোট্ট মেয়ে ঞোমে-কে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। হেমন্তের শেষ মুহূর্ত। কৃষাণেরা জমির ধান কেটে গোলায় তুলে রেখে দিয়েছে। একদিন সকালে তাদের বাড়ির উঠানে ধান শুকায়ে দিয়ে কৃষক তার স্ত্রীকে সংগে নিয়ে পাশের বনে কাঠ সংগ্রহ করতে গেল। ঞোমে-কে ধানের পাহারা দিতে কড়া নির্দেশ দিয়ে যায়। আগন্তুক কেউ এসে যেন একটা ডানাও খেতে বা নিয়ে যেতে না পারে। ঞোমে খুশি মনে পাহারা দিতে লাগল। এমন সময় একঝাঁক সাদা টিয়ে পাখি খাবার খোঁজ করতে করতে মাঠে কোথাও খাবার না পেয়ে কৃষকের বাড়ির উঠানে এসে নামল। তারা মেয়েটির কাছে কিছু খাবার চাইল। ঞোমে তার বাবা মায়ের নিষেধের কথা মনে করে কোন অবস্থাতে রাজী হয় না। টিয়েরা অনেক অনুনয় বিনয় করে মেয়েটির মন গলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করল। মেয়েটি জবাব দেয়, সে তাদেরকে ধান খেতে দিলে বাবা মা ফিরে এসে তাকে প্রচন্ড বকবে এমনকি প্রহারও করতে পারে। তখন টিয়েরা বলল তার বাবা মা যদি তাকে বকে কিংবা প্রহার করে তাহলে সে যেন তাদের কাছে পালিয়ে আসে। তাদের গ্রামের নাম ‘সাদা টিয়ে পাড়া’।

টিয়েরা ঞোমে-কে তাদের বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে সামান্য ধান খেতে দেয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করতে লাগল। মেয়েটি তাদের সামান্য পরিমান ধান খাওয়ার অনুমতি দিল। টিয়েরা খুশির মনে প্রায় অর্ধেক ধান খেয়ে উড়ে চলে গেল। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসরে কাঠ সংগ্রহ করে ঞোমের বাবা মা ফিরে এসে দেখে উঠানে অর্ধেক ধান নেই। তারা সরল সহজ অবুঝ মেয়েটিকে প্রহার করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। ঞোমে অনন্যোপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী তার আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যায়। আত্মীয় স্বজনরা কেউই অসহায় ঞোমে-কে আশ্রয় দেয় না নিয়ে ভুল বুঝে উল্টো বকাবকি করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। অবশেষে ঞোমে সাদা টিয়েদের কথা মনে পড়ল। সে টিয়েদের কথামতো ’সাদা টিয়ে পাড়া’ অভিমুখে যাত্রা করল। যেতে- যেতে- যেতে গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে পুরো একদিন হাটাঁর পরে সে অজানা একটি গ্রামে এসে জিজ্ঞেস করল ’সাদা টিয়ে পাড়া’ আর কতদূর। গ্রামের লোকটি বলল ’এটাই সাদা টিয়ে পাড়া’। খবর শুনে টিয়েরা এসে ফর্সা বর্ণের মেয়েটিকে অভ্যর্থনা জানাল।
তারা ঞোমে-কে জিজ্ঞেস করল যে, সে কোন্ সিঁড়ি দিয়ে উঠবে। সোনার সিঁড়ি না বাঁশের সিঁড়ি? ঞোমে জবাব দিল- সে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে উঠবে। টিয়েরা তাকে সোনার সিঁড়ি দিয়ে তাদের দোতলা বাড়ীতে উঠাল। মেয়েটি সারাদিন পদব্রজে এসেছে। নিশ্চয় তার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। খাবার খেতে দিতে গিয়েও টিয়েরা তাকে জিজ্ঞেস করল- সে কোন্ থালা দিয়ে খাবে, সোনার থালা না মাটির থালা, সোনার চামচ না পিতলের চামচ, সোনার গ্লাস দিয়ে পানি খাবে না মাটির পাত্র দিয়ে। এমনি করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ঞোমেকে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা করল। ঞোমে তার স্বভাব মতই অতি সাধারণভাবে প্রতিটি প্রশ্নের নিজের tradition বজায় রেখে উত্তর দিল। টিয়েরা ভীষণ খুশী হয়ে তাকে প্রত্যেক ক্ষেত্রে সোনার তৈরী বস্ত্ত দিয়ে পরিবেশন করল। এমনকি ঘুমোবার সময়ও ঞোমেকে সোনার পালঙ্কে ঘুমোতে দিল। বেশ কয়েকদিন আনন্দে কাটার পর ঞোমে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবার জন্য কাঁদতে লাগল। টিয়েরা তাকে আর একটি মাত্র রাত থেকে পরের দিন সকালে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। ঞোমেও স্বানন্দে রাজী হল। ঐ রাতে সব টিয়ে মিলে তালপাতা দিয়ে একটা সুন্দর বাক্স তৈরী করল। সকাল বেলা ঐ বাক্সটি তারা ঞোমেকে উপহার দিয়ে বলল এটা যেন সে পথের মধ্যে কোথাও না খুলে। খুললেই সে অসত্ লোকের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবা, নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ডেকে বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে বাক্সটি খুলতে হবে। ঞোমে টিয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে চল্ল। টিয়েদের কথামতো সে পথে কোথাও বাক্সটি খুলে দেখলো না। বাড়ীতে পৌঁছা মাত্রই অতি প্রিয় মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে একত্রে দেখতে পেল। ঞোমে হারিয়ে যাওয়ায় তারা গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। সাদা মাটা স্বলপ উচ্চতাবিশিষ্ট  গৌরীর চেহারার অধিকারীনি ঞোমে-কে ফিরে পেয়ে সবাই প্রফুল্ল মনে ঘিরে ধরল। এতদিন কোথায় ছিল, খাওয়া দাওয়া কোথায় হয়েছিল নানাবিধ বিষয় মেয়েটির কাছ থেকে জানতে চাইল। মেয়েটি তাদের সবাইকে বাড়ির অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে বলল। তারপর বিস্তারিত ব্যাখা প্রদান করে টিয়েদের উপহার দেয়া তালপাতা বাক্সটি খুল্ল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। বাক্সের ভিতর সব সোনা, হীরা, মনিমুক্তা। বাক্সটি খোলার সাথে সাথে গরীর ঘরময় ঝলমল ও উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হতে লাগল। এ অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করে উপস্থিত সবাই ঞোমে-কে খাতির যত্ন করতে লাগল।

ঞোমেও প্রীত মনে বাক্সের ভেতর থেকে উপস্থিত সবাইকে এক একটা উপহার দিল। সবাই যার পর নাই খুশি মনে নিজ নিজ বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করল। গরীব কৃষকের জীবনযাত্রা নিমিষে চোখে পড়ার মত পাল্টে গেল। তারা সুন্দর একটা বাড়ী তৈরী করে সুখে শান্তিতে  বাস করতে লাগল।

তাদের এহেন রাতারাতি গরীব থেকে বিত্তবান্ন হওয়ার বিষয়টি প্রতিবেশী আর এর গরীর কৃষক পরিবার হিংসায় জ্বলে পুড়তে লাগল। কি করে তারা এমন হঠাত্ ধনী হয়ে গেল ভেবে তারা কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না। অনেক খোঁজ খবর তথ্যানুসন্ধান তারা অবশেষে গোপন রহস্য জানতে পারল। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে ঠিক করল তারাও অনুরূপভাবে ধনীলোক হবে। পরিকল্পনামতে পরেরদিন সকালে উঠানে ধান শুকানো হল। সোমে নামে এগার বছরের মেয়েটিকে পাহারায় রেখে স্বামী স্ত্রী বনে কাঠ কাটতে বের হয়ে গল। সত্যি সত্যি সাদা টিয়েরা ঐদিন আবার ধান খেতে লাগল। সোমে’র কাছে ধান না চাইতেই সোমে সব ধান দিয়ে দিল। টিয়েরা সব ধান শেষ করে উড়ে যাবার সময় সোমেকে ঠিকানা দিয়ে গেল যেন তার বাবা-মা বকাবকি করলে তাদের কাছে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যায় সোমে’র মা-বাবা ফিরে এসে যথারীতি মেয়েটিকে খুব প্রহার করে তাড়িয়ে দিল। সোমে ঞোমের মত সোজা টিয়েদের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল। টিয়েরা মেয়েটির চরিত্র পরীক্ষা করার জন্য তাকে আগের মত বিভিন্ন প্রশ্ন করল। সিঁড়ির প্রশ্নে সোমে সোনার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চাইল। টিয়েরা তাকে নড়বড়ে এক পুরনো বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে বাড়িতে উঠাল। খেতে বসেও সোমে সোনার থালা, সোনার চামচ, সোনার গ্লাস ইত্যাদি সব কিছুতেই সোনার তৈরী জিনিস ব্যবহার করতে চাইল। প্রত্যেক ক্ষেত্রে টিয়েরা তাকে মাটির তৈরী বস্ত্ত দিয়ে পরিবেশন করল। একদিন থাকতেই সোমে যাবার জন্য কান্নাকাটি আরম্ভ করল। টিয়েরা তাকে যথারীতি একটা তালপাতার বাক্স প্রদান করে পথে কোথাও খুলে না দেখার জন্য বারণ করল এবং বাড়িতে সকল আত্মীয়-স্বজনকে ডেকে দরজা জানালা বন্ধ করে খোলার কথা বলে সোমেকে বিদায় দিল। সোমে মহাখুশি হয়ে বাড়িতে ফিরে আসল।

বাড়িতে পৌঁছতেই আত্মীয়-স্বজনকে ডেকে এনে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে তালপাতার বাক্সটি খোলা হল। সাথে সাথেই বাক্সটি থেকে নানা প্রকার বিষধর সাপ বের হয়ে উপস্থিত সবাই ছোবল মারল। একের পর এক সবাই সাপের দংশনে মৃত্যু বরণ করল। পালাতে গিয়েও কেউ রেহাই পেলনা। পাড়া পড়শীরা ব্যাপারটা দেখে কেউ আর লোভ করতে সাহস করল না। এ ঘটনা থেকে সবাই অনুধাবন করতে পারল লোভে পাপ-পাপে মৃত্যু।

লেখক পরিচিত : লেখক ও গবেষক।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

দ্রুত ও স্থায়ী অবসান হোক রোহিঙ্গা সমস্যার

-: তাওহীদুল ইসলাম নূরী :- ২৫ আগষ্ট ২০১৯, রোহিঙ্গা সমস্যার দুই বছর পূর্তি হল। একে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/