বিগত সাড়ে চার বছরে যেন এক নিঃসীম দুঃস্বপ্নের মাঝে বাস করছে সিরিয়া। দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যেই ঘটেছে অন্তত আড়াই লাখ মৃত্যু। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ থেকে পুর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধে জর্জরিত এখন তারা। অহর্নিশ মৃত্যুভয়ে থাকা ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ হয়েছে বাস্তুহারা। ২০১১ সালের মার্চে শুরু হওয়া এই সংকট এখনো পর্যন্ত শেষ হবার কোন আশা দেখা যাচ্ছে না।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী এবং তার প্রতিপক্ষ, এমনকি ইসলামিক স্টেট (আইএস) চালিয়ে যাচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। প্রভাবশালী দেশগুলো বরং মদদ দিয়ে যাচ্ছে এই সংঘর্ষে।
অন্যদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় খুবই কম ভূমিকা পালন করতে পারছে জাতিসংঘ। এমনকি সম্প্রতি এটাও জানা গেছে, জাতিসংঘের ত্রাণ পৌঁছে দেবার কাজ করছে যেসব পুরুষ, তাদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে সিরিয়ার নারীরা। জানা যায়, ত্রাণ আটকে রেখে অল্প সময়ের জন্য এসব পুরুষদের সঙ্গ দিতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। ত্রাণের আশায় এতে রাজি হয়ে যান দুস্থ নারীরা। বিগত তিন বছর ধরে এই অত্যাচার চলছে তাদের ওপর।
২৭ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হবার কথা দেশটিতে। পূর্ব ঘৌতা এলাকায় বিদ্রোহীদের ওপর সরকারের আক্রমণে এই যুদ্ধবিরতির আদেশ দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়ার মদদেই এই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল সরকার।
সিরিয়ার এই যুদ্ধের ব্যাপারে অজ্ঞ নয় পৃথিবীর মানুষ। সিরিয়ায় মৃত্যুবরণ করা অগণিত নাম না জানা শিশুদের ছবিতে কয়েকদিন পর পরই ছেয়ে যাচ্ছে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের পাতা। গোলাপের মতো রক্তিম গাল আর প্রাণহীন নীল চোখের শিশুগুলোর ছবি দেখে অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ছেন তারা।
২০১১ সালে কী করে শুরু হয়েছিল এই সংকট, আর কী করেই তা আগ্রাসী এক গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে, তার পুরোটাই আজ দেখে নিন এক নজরে। তবেই কেবল অনুভব করা যাবে এ সময়ের মাঝে মানবতা কী করে খুন হয়েছে সিরিয়ার শহরে শহরে।
১) বিদ্রোহ থেকে সহিংসতা
২০১১ সালে কিছু তরুণ সিরিয়ার দক্ষিণে দেরা শহরে দেয়ালে দেয়ালে গণতান্ত্রিক স্লোগান লেখার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। এরপরই গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। নিরাপত্তা কর্মীরা সরাসরি গুলিবর্ষণ করে মিছিলের ওপর। ফলে বিক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।
প্রেসিডেন্ট আসাদের পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হয়। হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় বিদ্রোহীরা। প্রথমে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, এরপর নিজ এলাকা থেকে সরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের বিতাড়নের জন্য।
২) গৃহযুদ্ধের সূচনা
সরকারের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। তৈরি হয় বিদ্রোহী দল। তারা বিভিন্ন শহর ও গ্রামের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে। রাজধানী দামেস্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পোতে এই সংঘর্ষ পৌঁছে যায় ২০১২ সালে।
২০১৩ সালের জুন মাসের মাঝে ৯০ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০১৫ সাল নাগাদ তা আড়াই লাখে গিয়ে ঠেকে, জানায় জাতিসংঘ।
এখন আর শুধু প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে না এই যুদ্ধ। বরং শিয়া-সুন্নী বিরোধে উপনীত হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পরাশক্তিরাও রক্তের গন্ধ পেয়ে যোগ দিয়েছে এই হত্যাযজ্ঞে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) তেমনই এক শক্তি।
৩) যুদ্ধাপরাধ
জাতিসংঘের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই সংঘর্ষে জড়িত প্রতিটি পক্ষই যুদ্ধাপরাধে দায়ী। খুন, গুম, অত্যাচার এবং ধর্ষণ এর মাঝে কয়েকটি। নিরীহ বাসিন্দাদের খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসা পাবার অধিকারও হরণ করেছে তারা, শুধুই যুদ্ধের কৌশল হিসেবে।
৪) রাসায়নিক অস্ত্র
২০১৩ সালের আগস্টে নার্ভ এজেন্ট সারিন গ্যাস ভর্তি রকেট ফেলা হয় দামেস্কে। এই হামলার জন্য পাশ্চাত্য দায়ী করেছে সিরিয়ার সরকারকে। কিন্তু সরকার বলছে তা বিদ্রোহীদের কাজ। দায়ী যেই হোক না কেন, এর পরিণাম হয় ভয়াবহ। আইএস ঘরে তৈরি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে বলেও জানা গেছে।
৫) মানবাধিকার সংকট
৪৫ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে এই সংঘর্ষ শুরুর পর। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। প্রতিবেশি দেশ লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্ক এত বেশি পরিমাণ শরণার্থী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সিরিয় শরণার্থীদের মাঝে ১০ শতাংশ ইউরোপে পালিয়ে গেছে। এতে বিভিন্ন দেশের মাঝে তৈরি হয়েছে উষ্মা। সিরিয়ার ভেতরেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরও ৬৫ লাখ মানুষ।
বাস্তহারা এসব মানুষের জরুরি দরকার ত্রাণ। ৭০ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না, খাদ্যের অভাবে আছে এক তৃতীয়াংশ মানুষ। ২০ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। পাঁচভাগের চারভাগ মানুষই আকণ্ঠ ডুবে আছে দারিদ্রে।
তাদের ত্রাণ ও সহায়তা দেবার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না খুব একটা। কারণ প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ বাস করছেন এমন জায়গায় যেখানে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন।
৬) বিদ্রোহী এবং জিহাদী যোদ্ধার উত্তরণ
২০১১ সালের সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারী থেকে অনেকটাই আলাদা বর্তমানের বিদ্রোহীরা। শিয়া ও সুন্নী বিভেদে পড়ে গেছেন তারা। শুধু তাই নয়, ইসলামিস্ট এবং জিহাদিস্টদের উত্তরণ ঘটেছে সম্প্রতি। তাদের নৃশংসতায় হতবাক বিশ্ব।
সিরিয়ার সংকটের পুরো ফায়দা উঠিয়েছে ইসলামিক স্টেট। সিরিয়া এবং ইরাকের একটি বড় অংশে তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। সিরিয় বিদ্রোহীদের পাশাপাশি তারা আল-কায়েদা মদদপুষ্ট নুসরা যোদ্ধা এবং কুর্দি যোদ্ধাদের সাথেও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আইএস। পরের বছরই রাশিয়ার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য বিদ্রোহী এবং বেসামরিক মানুষ।
৭) শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
এই যুদ্ধে কোন পক্ষই একে অপরকে পর্যদুস্ত করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক মহলে এটাই ধারণা যে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবেই এই সংঘর্ষের সমাধান হতে পারে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলেও বারবারই তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে সিরিয়া সরকার। যদিও সম্প্রতি এক যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় আলোচনা হয় জাতিসংঘে।
৮) পটভূমি পরিবর্তন
সিরিয়ায় গণতন্ত্রের দাবিতে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তাকে আরব বসন্তের আরেক ফসল হিসেবে দেখেছিলেন অনেকেই। সেই বসন্ত শেষ হয়ে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে দেশটি। এক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে এখন তা হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ।
ইরান, লেবানন এবং রাশিয়া আসাদের শিয়া-প্রধান সরকারকে মদদ দিয়ে চলেছে।
অপরদিকে তাদের সুন্নী বিদ্রোহীরা পেয়েছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার এবং জর্ডানের সমর্থন। সূত্র:কে এন দেয়া-priyo.com;ডেস্ক।
You must be logged in to post a comment.