সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / কলাম / “স্কুল কোন কারখানা নয়”

“স্কুল কোন কারখানা নয়”

Nilopal Barua Profesor - (PP)-:  – প্রভাষক নীলোত্পল বড়ুয়া  :-

এবার কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি প্রক্রিয়া ছিল অনলাইনে। Smart Admission System| স্মার্ট এডুকেশন এর জন্য স্মার্ট ভর্তি প্রক্রিয়া। এখন তো আসলে স্মার্টের যুগ। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট কার্ড, স্মার্ট এডুকেশন ইত্যাদি। আমার এক বন্ধু স্মার্টের স্রোতে একটা স্মার্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত হয়েছিল। তার ভাষায় সে বেশি কিছু চিন্তা না করে নিজেকে জড়িয়ে ছিল। কারণ এই জড়ানোতে তার আবেগটাই নাকি বেশি কাজ করেছিল। বন্ধুটি একটা বিষয় মনে মনে সবসময় ধারণ ও লালন করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়; আইনস্টাইনের কথা- If your head tells you one thing and your heart tells you another, before you do anything, decide first whether you have a better head or a better heart| বন্ধুটি মনে করে তার হেড এর চেয়ে হার্ট বেটার। তাই সে মস্তিষ্কের যুক্তির চেয়ে হৃদয়ের আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই স্মার্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যাঁরা দেখেছিলেন তাঁদের সাথে জড়িত হয়েছিল।

বন্ধুটি স্কুল বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি না হলেও একদিন স্কুলের কিছু শিক্ষক তার সাথে আলাপ করতে আসে কিছু বিষয়ে নিয়ে। স্কুলের পরিচালনা কমিটির কর্তাব্যক্তি প্রদত্ত নিয়মের নির্দেশনা তাঁদের কাছে খড়গ সম চাপ মনে হলো। তাঁদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যেন “আমি মালিকপক্ষ, তোমরা শ্রমিক” এই বলে প্রতিভাত হল। তাঁরা হৃতমান বোধ করলেন তাঁর আচরণে। শিক্ষকদের আরও মনে হলো, তাঁরা যে পরিমাণ মানুষ তার চেয়ে অধিক মেশিন হিসাবে তাঁদেরকে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর কাজে ব্যবহারের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের নিজস্বতা, জ্ঞান, বুদ্ধি বলতে যেন কিছুই নেই। যেন তাঁরা পরাধীন দাস। হয়তো শিক্ষকরা এ সবকিছুই ভুল বুঝেছেন। আমার বন্ধুটি শিক্ষকদের কথাগুলো শুনলেন কেন তাই সভায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো- সে শিক্ষকদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে চাইলে তাকে থামিয়ে দেওয়া হল। বিষয়াবস্থা যদি সত্য হয় তবে স্কুলটি স্মার্ট স্কুল না হয়ে স্মার্ট কারখানায় পরিণত হবে যেখানে রোবট কর্তৃক তৈরি হবে আর ও উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন রোবট। অন্য দিকে বর্জ্য হিসাবে কারখানা থেকে নির্গত হবে মুখ্যতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার অভ্যাস যা আমাদের এই গণতান্ত্রিক পরিবেশকে দূষিত করবে।

‘স্মার্ট স্কুল’ মানে ‘আদর্শ বিদ্যালয়’ নাও হতে পারে।‘স্মার্ট এডুকেশন’ মানে ‘আদর্শ শিক্ষা’- এও না হতে পারে। আদর্শ একটি চিরায়ত ব্যাপার। আর ইংরেজী Smart শব্দটি clean/neat, intelligent, fashionable, quick, clever (disrespectful way) ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষার সাথে বিশেষণ হিসাবে স্মার্ট শব্দটা যায় কিনা তা তর্ক নিরপেক্ষ নয়। স্মার্ট এডুকেশন দ্বারা সফল হওয়া যেতে পারে, কিন্তু সার্থকতার জন্য কি? সফলতা আর সার্থকতার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, শিক্ষা দ্বারা যদি সেটাই নিরূপিত না হয় তবে তা আদর্শ শিক্ষা কখনই হতে পারে না। আদর্শ শিক্ষা ছাড়াও কিন্তু সফল হওয়া যায়। প্রমথ চৌধুরীর আলোকে বলা যায়, শিক্ষার মাহাত্ম্যের কথা ভুলে গিয়ে আমরা শিক্ষাকে আজ বাজারদর সম্পন্ন করে তুলেছি। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য আমাদের কাছে একটি ভাল বেতনের চাকরি। যে শিক্ষা এটা নিশ্চিত করতে পারে সে শিক্ষাই আমাদের কাছে স্মার্ট এডুকেশন বা ভাল শিক্ষা এবং এ শিক্ষাই আমাদের কাম্য। এক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর আরেকটি কথা বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ- “আমাদের স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা অর্জনের যোগ্য করে তোলার পরিবর্তে বিদ্যা গোলানো হয়। তা তারা জীর্ণ করতে পারুক আর নাই পারুক।ফলে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক মন্দাগ্নিতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে।”

ভাল স্কুল বা স্মার্ট স্কুল ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আমাদের যারপরনাই চেষ্টা। মূলত সব স্কুলই একরকম।এখানে ভাব, কাজ, প্রভাব ও ফল কোন কিছুতেই পার্থক্য নেই। পরীক্ষার ফলনির্ভর এক অন্ধ প্রতিযোগিতা। পরীক্ষার ফলের প্রতি অতিমাত্রায় লোভ করে বিদ্যা গেলাবার আয়োজন চলে সব স্কুলেই। এতে শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বুদ্ধি বন্ধ্যা হয়। অতিশ্রমের কারণে তাঁদের মন জীর্ণ হয়ে যায় এবং বিদ্যার প্রতি অনুরাগ থাকেনা। ফলে ঘটে বিদ্যাবিভ্রাট। এই রূপ স্কুল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কটাক্ষ করে বলেছেন- “ইসকুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাষ্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়। মাষ্টারেরও মূখ চলিতে থাকে। চারটার সময় কারখানা বন্ধ হয়। মাষ্টার-কলও তখন মূখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই, চার পাতা কলে-ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তারপর পরীক্ষার সময় বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপর মার্কা পড়িয়া যায়।” এই সমস্ত স্কুলের পরিবেশে আমরা ভুলে যাই যে মানুষ মানুষের কাছ হতে যা পায় কলের কাছ হতে পেতে পারেনা। আইন দ্বারা শিক্ষকরা বিশাল কলের যন্ত্রাংশে পরিণত হয়। তাঁরা শুধু তেল দিতে পারে কিন্তু আলোর জ্বালাবার সাধ্য তাঁদের থাকে না। তাঁরা শুধু বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।

রবীন্দ্রনাথ যাকে অলঙ্ঘ্য সত্য হিসাবে স্বীকার করেছেন- “শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রাণালীর দ্বারা হয় না।” এ প্রসঙ্গে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, আইনপ্রধান ও উপকরণবহুল শিক্ষার ক্ষেত্রে আইন ও উপকরণকে শিক্ষার উপায় না করে লক্ষ্য করে তুললে শিক্ষার ফল কি হবে? পরিহাসের বিষয় শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষককে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে আইনের হাতকড়া ও উপকরণের বেড়ি। এ অবস্থায় একজন শিক্ষকের মুখ দিয়ে কি বের হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বন্দি মানুষের বিচরণ কি অবাধ ও স্বাভাবিক হতে পারে? এ যেন হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়ে মুক্ত জীবনের জয়গান করতে দেওয়া। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, আইনের প্রধান্য নয়, শিক্ষায় ঘটাতে হবে শুভবুদ্ধির জাগরণ। এটাই সত্য। চাষের মধুর পুষ্ঠিগুণ কখনো বন্য মধুর পুষ্ঠিগুণের মত শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।

আমরা শিক্ষককে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেই না, নিয়োগ দেই সাধারণ চাকুরিজীবী হিসাবে। কিন্তু মহত্ পেশাজীবী হিসাবে তাদেরকে মন্ত্রণা দেওয়ার চেষ্টা করি। এ বড় শঠতা! আগে ছিল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। এখন হয়েছে ছাত্র-শিক্ষক। গুরুকে হতে হয় সহৃদয় শিক্ষক। এখন কথা হলো হৃদয়ের ব্যবহারই যদি আমরা শিক্ষকে করতে না দেই তবে তিনি সহৃদয় হবেন কিভাবে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বলেছেন- “শিক্ষক কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেই জোটে, কিন্ত গুরু তো ফর্মাশ দিলেই পাওয়া যায় না।—– আমরা যাঁহাকে স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ করি তাঁহাকে এমন করিয়া ব্যবহার করি যাহাতে তাঁহার হৃদয় মনের অতি অল্প অংশই কাজে খাটে। ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের সঙ্গে একখানা বেত এবং কতকটা পরিমাণ মগজ জুড়িয়া দিলেই শিক্ষক তৈরি করা যাইতে পারে।” রবীন্দ্রনাথের এই কথার আলোকে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন-“এতে ছাত্রেরও দোষ নেই, শিক্ষকেরও দোষ নেই। হেডমাষ্টার থেকে ইনস্পেক্টর, ইনস্পেক্টর থেকে ডাইরেক্টর এই কামনা করেন।”আবার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এও বলেছেন যে এই শিক্ষককে যদি গুরুর আসনে বসিয়ে দেওয়া হয় তবে স্বভাবতই তাঁর হৃদয়-মনের শক্তি সমগ্রভাবে শিষ্যের প্রতি ধাবিত হবে। কলের যেমন নিয়ম আছে প্রাণ নেই তেমনি বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতিও প্রাণবর্জিত নিয়মপ্রধান। আজ শিক্ষককে দোকানদার, বিদ্যাবিক্রেতা ব্যবসাদারে পরিণত করা হয়েছে। তাই তিনিও খরিদ্দারের সন্ধানে ফেরেন। যেখানে তাঁর বিদ্যা চলেনা সেখানে তিনি অন্য ব্যবসা করেন। ব্যবসাদারের কাছে কিন্তু লোক বস্তুই কিনতে পারে। যে পরিমাণ টাকা, সে পরিমাণ বস্তু। সেখানে তো স্নেহ, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা প্রভৃতি হৃদয়ের সামগ্রী থাকার কথা নয়। এগুলো পেতে চাইলে শিক্ষককে বেতনেরও অধিক গুরুর আসনে বসাতে হবে। নয়তো শিক্ষক বেতন অনুসারে বিদ্যাবস্তু বিক্রয় করবেন এবং এখানেই ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।

রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির গলদের মধ্যে শিক্ষার অস্বাভাবিকতা ও আনন্দহীনতাকেই প্রধান বলে আবিষ্কার করেছেন। আর মোতাহের হোসেন চৌধুরী বর্তমান শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন “শিক্ষা জিনিসটা বর্তমানে নাগরিক সভ্যতার বিলাসের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার বাহার আছে, কিন্তু কার্যকারিতা নেই; রূপ আছে, কিন্তু গন্ধ নেই।” শিক্ষার ক্ষেত্রে যে নিয়ম-কানুন, আইন-প্রণালী, বিধি-বিধান, আয়োজনের আড়ম্বরতা বর্তমানে প্রচলিত হয়েছে তা শিক্ষাকে মূলত তোতাকাহিনীতে পরিণত করেছে। এতে শিক্ষক ও ছাত্রের পরিশ্রমটাই শিক্ষার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকও খাটছে, ছাত্রও খাটছে। চিত্তের সজীবত্ব যে নষ্ট হচ্ছে তাতে কারো দৃষ্টি নেই। শিক্ষক খাটছে চাকরি বজায় রাখার জন্য আর ছাত্র খাটছে পরীক্ষায় পাস করার জন্য। আমরা ভুলে যাই যে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা- “সুগমতা, সরলতা, সহজতাই যথার্থ সভ্যতা, বহু আয়োজনের জটিলতা বর্বরতা, বস্তুত তাহা গলদঘর্ম অক্ষমতার স্তুপাকার জঙ্গল।” আসবাবের বাহুল্যকে ঐশ্বর্য বলা যেতে পারে কিন্তু সভ্যতা বলা যায় কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন- “কোন মতে নয়টা দশটার মধ্যে তাড়াতাড়ি অন্ন গিলিয়া বিদ্যা শিক্ষার হরিণবাড়ির মধ্যে হাজিরা দিয়া কখনোই ছেলেদের প্রকৃতি সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করিতে পারেনা। শিক্ষাকে দেয়াল দিয়া ঘিরিয়া, গেট দিয়া রুদ্ধ করিয়া, দারোয়ান দিয়া পাহারা বসাইয়া, শাস্তি দ্বারা কন্টকিত করিয়া, ঘন্টা দ্বারা তাড়া দিয়া মানবজীবনের আরম্ভে একি নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে।” ছাত্র-শিক্ষক উভয়েরই জন্য এ যেন এক কারাগার। এখানে মননশক্তি নিয়ে কাজ করার তেমন কোন পরিবেশ না থাকায় চলে স্মরণশক্তি নিয়ে বেশিরভাগ কাজ। তাই নির্মাণের চেয়ে সংগ্রহের কাজটা বড় হয়ে উঠে। এ অবস্থায় পন্ডিতষ্মন্য হওয়া গেলেও পান্ডিত্য অর্জন কখনই সম্ভব নয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটাও ঠিক যে পন্ডিত না হলেও পন্ডিতষ্মন্য হওয়া যে আমাদের লক্ষ্য। স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করে কথায় কথায় বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বৃতি দিতে পারলেই পন্ডিত হওয়া যায় না। সুস্থ ও সুষ্ঠু বিচার-বিশ্লেষণেই পান্ডিত্য। মননশক্তি ও বিচারবোধের উন্মেষ সাধনই পান্ডিত্য অর্জন। মনে রাখা দরকার অতিরিক্ত বুদ্ধির চর্চা মানুষের চিত্তকে নিরসও করে তুলতে পারে। আর অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ-সাইজ করে রাখে। আমাদের স্কুলগুলোকে যেন মনুষ্যত্ব বিকাশের পরিবর্তে শুধুমাত্র পান্ডিত্য চর্চা ও বুদ্ধি চর্চার কনসেনট্রেশন ক্যাম্প করে তোলা হচ্ছে। এতে বিদ্যা অর্জনের চেয়ে বিদ্যার সার্টিফিকেট অর্জনের জন্যই এক প্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। বিদ্যা না জুটলেও বিদ্যার উপাধি জোটে। এই রূপ বিধিপ্রধান স্কুলগুলোতে শিক্ষকের অবস্থা ও অবস্থানের যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা রবীন্দ্রনাথের কথায় সহজে অনুমেয়- “মানুষ মানুষের কাছ হইতে শিখিতে পারে; জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়, শিখার দ্বারাই শিখা জ্বলিয়া উঠে, প্রাণের দ্বারাই প্রাণ সঞ্চারিত হইয়া থাকে। মানুষকে ছাঁটিয়া ফেলিলেই সে তখন আর মানুষ থাকেনা, সে তখন আপিস-আদালতের বা কল-কারখানার প্রয়োজনীয় সামগ্রী হইয়া উঠে; তখনি সে মানুষ না হইয়া মাস্টার মশায় হইতে চায়; তখনি সে আর প্রাণ দিতে পারেনা, কেবল পাঠ দিয়া যায়”।

আমাদের আধুনিক স্মার্ট শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনের বিষয় পুরোমাত্রায় থাকলেও রয়েছে সংস্কৃতির অভাব অতিমাত্রায়। শিক্ষা হয়ে পড়েছে বিত্তকেন্দ্রিক, চিত্তকেন্দ্রিক নয়। তাই আমরা পড়ালেখা করে বিত্তশালী হতে পারলেও থাকি বৈভবহীন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন- “একালে যাকে আমরা এডুকেশন বলি তার আরম্ভ শহরে। তার পিছনে ব্যবসা ও চাকরি চলেছে আনুসাঙ্গিক হয়ে।” শুধু দক্ষতা শিক্ষা হতে পারেনা। তিনি বলেন- “যে মানুষ উপকরণ নিয়ে বড়াই করে সে জানে না সে আসলে কত গরিব।” তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে আধুনিক শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি স্খলিত হয়ে পড়েছে। এখানে চিত্তের ঐশ্বর্যকে অবজ্ঞা করে জীবনযাত্রার সিদ্ধি-লাভকেই একমাত্র প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে তো এই সিদ্ধি-লাভ কখনোই যথার্থভাবে সম্পূর্ণ হতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথ বলেন- “যথার্থ সংস্কৃতি জড়ভাবে প্রথা পালনের চেয়ে অকৃত্রিম সৌজন্যকে বড় মূল্য দিয়ে থাকে। মানুষের সংগে ব্যবহারে কাজ উদ্ধার করার উপযোগী বিনয়কৌশল তার অনুশাসন নয়; সংস্কৃতিবান মানুষ নিজের ক্ষতি করতে পারে কিন্তু নিজেকে হেয় করতে পারেনা। সে আড়ম্বরপূর্বক নিজেকে প্রচার করতে বা স্বার্থপরভাবে সবাইকে ঠেলে নিজেকে অগ্রসর করতে লজ্জাবোধ করে। যা কিছু ইতর বা কপট তার গ্লানি তাকে বেদনা দেয়। —- সকল প্রকার শ্রেষ্ঠতাকে সম্মান করতে সে আনন্দ পায়। সে বিচার করতে পারে, ক্ষমা করতে পারে, মতবিরোধের বাধা ভেদ করেও যেখানে যে টুকু ভালো আছে সে তা দেখতে পায়, অন্যের সফলতাকে ঈর্ষা করাকে সে নিজের লাঘব বলেই জানে।” রবীন্দ্রনাথ মনে করেন শিক্ষার ভিতর দিয়ে শিশুকাল থেকে যে ইতরতার বিষবীজ বপন করা হয় তাতে আমরা তীক্ষ্ম মেধার গুণে পড়া মুখস্থ করে বি.এ, এম.এ পাস করি কিন্তু আমরা হয়ে উঠি পরস্পরের সৌভাগ্যবিদ্বেষী, নিন্দুক, লোভী, কুত্সা রটনাকারী, অপরের কল্যাণে বাধা সৃষ্টিকারী, পরস্পরের মিলন পথে কাটার বীজ বপনকারী, সদনুষ্ঠান নষ্টকারী দৈন্য চরিত্রের অধিকারী। এর কারণ শিক্ষার মধ্যে সংস্কৃতির অভাবে মনুষ্যত্বের আদর্শ ক্ষুন্ন হয়েছে বলেই। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে পরীক্ষা পাশের জন্য পড়া মুখস্থ করানো নয়, মানুষের ইতিহাসে যা কিছু ভালো তার সংগে আনন্দময় পরিচয় সাধন করিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করবার সুযোগ ঘটিয়ে দেওয়া।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন- কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। সংস্কৃতি মানে জীবনের মূল্যবোধ (values)|কালচার্ড ব্যক্তিরা কোন নির্দিষ্ট মতবাদী নয়। কারণ মতবাদ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। সংস্কৃতিবান মানুষেরা সত্যকে ভালবাসে, সৌন্দর্যকে ভালবাসে। বিনালাভে নিজের ক্ষতি স্বীকার করেও ভালবাসে। সংস্কৃতি মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে। নিজের দলের মানুষের জন্য সাতখুন মাফ আর বিপরীত মতবাদের হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের দোষ বের করা মতবাদীদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে যায়। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না। মতবাদীরা অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তাদের আইডিয়াটা থাকে এক প্রকার গোঁড়ামির পর্যায়ের। নিজের মত বা আইডিয়াটাই অভ্রান্ত মনে করা অন্ধত্ব। এর থেকে মুক্তির উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে আর এই সৌন্দর্য্যই সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকামীরা ভিন্নমতকেও সম্মান করে। তাদের Let us agree to differ| আমাদের শিক্ষায়, শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষা পদ্ধতিতে একজনকে সংস্কৃতিকামী করে তোলার উপাদান নাই বললেই চলে। শিক্ষাকে আমরা অর্থকরী করে তোলেছি। জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিসটাকে টাকা দিয়ে যে কেনা যায় না বা আংশিকভাবে যে পাওয়া যায় না তা আমরা বুঝি না।

বার্ট্রন্ডে রাসেলের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীর মধ্যে vitality, courage, intelligence I sensitiveness এই চারটি গুণ সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীকে successful করে তোলা শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য মানুষ করে তোলা। বুদ্ধি, বিচারবোধ ও কল্যাণানুরাগে শিক্ষার্থীর চিত্ত ঐশ্বর্য্যশালী করে তোলা। আর আমরা শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিয়ে একই বেঞ্চে বসা একজনকে আরেকজনের প্রতিদ্বন্দী হিসাবে গড়ে তোলছি। এতে করে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে success এর প্রতি অন্ধ এবং তাদের মধ্যে লোপ পাচ্ছে মনুষ্যত্বের এক মহত্গুণ ভ্রার্তৃত্ববোধ। success কে বড় করে দেখলে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে অনেক নীচে নেমে যেতে হয়। কারণ কতগুলো জঘন্য মনোবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করে সংসারে সহজে কৃতকার্য্যতা লাভ করা সম্ভব। তোষামোদ, আত্মপ্রচার, গায়ে-পড়া ভাব, বেহায়াপনা, চালিয়াতি ইত্যাদি ছাড়া যে আজকের দিনে সংসারে কৃতকার্য্যতার মুখ দেখা মুশকিল তা দৃষ্টি ও বোধ বিবর্জিত মানুষ ছাড়া সকলে স্বীকার করতে বাধ্য। এই জিনিসগুলো দিন দিন মানুষকে নীচে নামিয়ে পশুতে পরিণত করে।

শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত অন্তরের দিকে। “লেখা পড়া করে যেই গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই”- এ শিক্ষা বড়ো হীনতার, বড়ো দীনতার। লেখাপড়া না করেও গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া যায়, গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া যায়। এটা সফলতা, সার্থকতা কোনমতেই নয়। শিক্ষা কিন্তু কড়ির মানে ভারি ভারি ডিগ্রির বস্তা বোঝাই করা নয়। এতে বোঝাইয়ের গৌরব থাকলেও প্রাণের গৌরব নেই। তাই অনেকে উপাধি পেলেও বিদ্যা পায় না। শিক্ষার মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে এই মন্ত্রই ঢুকিয়ে দিতে হবে- তুমি কেরানির চেয়ে বড়ো, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টার-সচিব-ডিসি-এসপি-ম্যাজিষ্ট্র্রেটের চেয়েও বড়ো। তোমার গন্তব্য নিরাপদ পেনশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটাই এখন আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের স্কুলেও এ শিক্ষা নেই।

বন্ধুর ঘটনার প্রসংগক্রমে অনেক কথা চলে আসল। এখানে আমার নিজের কথার চেয়ে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথার আধিক্যই বেশি। আসলে বন্ধুটি এই কথাগুলো দিয়েই অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সমস্ত বিষয়ে তাদের হয়তো যথেষ্ট জানা আছে বলেই তাকে শুরুতেই থামিয়ে দেয়া হয়েছিল।

লেখক:- সিনিয়র প্রভাষক, ইংরেজী, হাজ্বী এম, এ কালাম ডিগ্রি কলেজ,নাইক্ষ্যংছড়ি,বান্দারবন

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

দ্রুত ও স্থায়ী অবসান হোক রোহিঙ্গা সমস্যার

-: তাওহীদুল ইসলাম নূরী :- ২৫ আগষ্ট ২০১৯, রোহিঙ্গা সমস্যার দুই বছর পূর্তি হল। একে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/