সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / কলাম / ১০২ জন ইয়াবাবাজের আত্মসমর্পণ : মাদক প্রতিরোধ অভিযানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে

১০২ জন ইয়াবাবাজের আত্মসমর্পণ : মাদক প্রতিরোধ অভিযানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে

-: মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :-

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ হাইস্কুল মাঠে ১০২ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবাবাজ আত্মসমর্পন করেছে। আত্মসমর্পণকারীদের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ পিচ ইয়াবা টেবলেট ৩০ টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও ৭০টি তাজাকার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে টেকনাফ মডেল থানায় দু’টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশ আত্মসমর্পনের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এ কার্যক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এরমধ্যে প্রক্রিয়াটাকে সাধুবাদ জানানোর সংখ্যাই বেশী বলে মনে হয়েছে। প্রথমেই বলে নেয়া ভাল-এই লেখাটা একান্তই আমার নিজস্ব চিন্তা ভাবনা থেকে লিখেছি।

যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের অধিকাংশই ১৬ ফেব্রুয়ারির অনেক আগে থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিল। কিন্তু তাদের জন্য দায়েরকৃত দু’টি মামলার এজাহারে ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫’১৫ মিনিটে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়া পাড়ায় মেরিন ড্রাইভ রোডের পূর্ব পাশ থেকে আটক করা হয় মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধি’র ৬১ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃত একজন আসামীকে পুলিশ ধৃত করার পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে হাজির করতে হয়। আসামীকে ধৃত করার ২৪ ঘন্টা পার হওয়ার পর আাসামীকে আদালতে পাঠনো হলে সেটা কোনভাবেই আইনসম্মত হবেনা। আমার মনে হয়-সেই আইনী বাধ্যবাধকতা সহ আরো কিছু কারণে ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে আত্মসমর্পণকারীদের ধৃত করা হয় মর্মে দেখানো হয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে-১০২ জন ইয়াবাবাজের আত্মসমর্পণ এবং বিগত সালের মে মাস থেকে গত ৮ মার্চ পর্যন্ত কথিত বন্ধুকযুদ্ধে ৭২ জন নিহত হয়েছে। তারপরও কেন ইয়াবাবাজদের বেপরোয়া কারবার থামছেনা? ১৬ ফেব্রুয়ারি যেদিন ১০২ জন ইয়াবাবাজ আত্মসমর্পণ করেছে সেদিনও কক্সবাজারের ৩টি স্থান থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজার পিচ ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মতে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করে মাদকের বিরুদ্ধে তাদের চলমান অভিযান ক্ষিপ্র থেকে ক্ষিপ্রতর করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে-‘ইয়াবা নগরী’ টেকনাফ সহ আশেপাশের এলাকা যেন ইয়াবার বন্যায় ভাসছে। কিন্তু কেন? আসলে ইয়াবার মূল উৎস কোথায়? আগে সেটা নিয়ে আলোচনা করি। ইয়াবা উৎপদান হয়-প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়নমারে। এছাড়া থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতেও। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন ইয়াবা উৎপাদন হয় বলে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। তাহলে মায়ানমারের টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষংছড়ির সীমান্ত দিয়েই অধিকাংশ ইয়াবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের সীমান্ত পাহারায় দেশের একটি সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত বাহিনী রয়েছে। যাদের অবদান ও ত্যাগ দেশমাতৃকার ভাবমূর্তি ও অর্জনের ঝুলিকে সমৃদ্ধ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত সীমান্তরক্ষায় এই বাহিনীর বিশাল অবদান ও ত্যাগকে আমরা সবসময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। বাংলাদেশের সীমান্তে যেখানে সমুদ্রসীমা রয়েছে, সেখানে ঐ সীমান্ত বাহিনীর সাথে কোষ্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও সীমান্ত পাহারায় অংশ নেয়। এখন প্রশ্ন হলো-সীমান্ত থেকে ইয়াবা পার হতে বাহিনীটি কতটুকু নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্বপালন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল অন্য একটি বাহিনীর জেলার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন-সীমান্তে দায়িত্ব পালনরত বাহিনীটির সম্মতি ছাড়া ইয়াবার একটি চালানও কোনদিন, কোনসময়, কোনভাবে এদেশে পার হয়নি। শুধুমাত্র ঐ বাহিনীর সাথে কন্ট্রাক্ট করলেই ঐ কন্ট্রাক্টের উপর ভিত্তি করে ওপার থেকে ইয়াবা এপারে আসতে পারে। উদ্ধৃতি দেয়া বাহিনীটির প্রদত্ত তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে সীমান্তে দায়িত্বপালনরত বাহিনীটি এদেশে ইয়াবা প্রবেশের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অবশ্য এ বিষয়ে গা শিউরে উঠা তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে দু’সপ্তাহ আগে প্রচার হলেও এবিষয়ে বাহিনীটি এ পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এ বাহিনীটির কি কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই? তারা সরকারের মৌলিকনীতি মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ এর বিপরীতে কর্মকান্ড করছে কেন? তারাও তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নিয়ন্ত্রনাধীন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ইয়াবা পাচারে জড়িত থাকার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপি ইয়াবাবাজদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রকাশ্যে জোরালোভাবে বলেছেন। এছাড়া পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যও ইয়াবার সাথে জড়িত বলে একই সুত্র তথ্য দিয়েছে। যখন ইয়াবার চালান পুলিশের হাতে ধরা খায়, তখন সোর্সমানি হিসাবে কিছু ইয়াবা এবং পুলিশের ক্ষুদ্র একটি অংশ নিজেরা কিছু নিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। তবে এ সংখ্যা কোন অবস্থাতেই শতকরা ৫ ভাগের বেশী নয়।

সূত্র মতে, বহুমুখী সাড়াশি অভিযানের কঠোরতায় তারাও এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রনের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু সীমান্তে যে বাহিনীটি দেশে ইয়াবার চালান প্রবেশের সাথে জড়িয়ে পড়ছে-সেখবর নিশ্চয় রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। যদি এসব তথ্য সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তে যে বাহিনীটি সীমান্ত সুরক্ষায় দায়িত্বে রয়েছে, তাদের অতীত কার্যক্রমকে তদন্তপূর্বক দায়িত্বহীনতা, অনৈতিকতা, শিষ্টাচার পরিপন্থী কাজ, রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী কর্মের কারণে কেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছেনা ? সীমন্তে কথিত অপকর্মে জড়িয়ে পড়াদের সরিয়ে একই বাহিনীর নতুন সদস্যদের কেন সেখানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছেনা? যদি নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, জবাবদিহিতা, দায়িত্বপালনে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়-তাহলে ইয়াবার প্রবেশদ্বারেই একটা ইতিবাচক ফলাফল আসতে পারে। এরপরও সীমান্ত বাহিনীর সকল তৎপরতাকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে যদি ইয়াবার চালান দেশে ঢুকে পড়ে-তাহলে তো নোম্যান্স ল্যান্ড থেকেই পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, যৌথ বাহিনী সহ দেশের অনেক বাহিনী রয়েছে, তাদের কারো না কারো দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারবেনা। এরপরও যদি ইয়াবার চালান ঢুকে পড়ে তার পরিমাণ হবে একেবার অল্প।

সীমান্তের ওপারে মায়ানমারে ইয়াবা উৎপাদনের যে কারখানা গুলো রয়েছে, আমার জানামতে-সে কারখানা গুলোতে উৎপাদিত শতভাগ ইয়াবা টেবলেট বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই কারখানা গুলোর অবস্থানের ভৌগলিক মানচিত্র আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আশাকরি রয়েছে। এ ম্যাপ মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) এর কাছে একসময় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছিল। এসব কারখানার বিষয়ে দ্বীপক্ষীয় কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বোঝাপড়ার মাধ্যমে, প্রয়োজনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে ওপারের কারখানা গুলো বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

কক্সবাজার জেলাশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসীর দেয়া তথ্যমতে, জেলার আদালত গুলোতে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মাদকের মামলা রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মামলাগুলো স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় থেকে বছরের পর বছর জট লেগে আছে। নিষ্পত্তি হচ্ছেনা সহজে। কক্সবাজার জেলায় জেলা ও দায়রা জজ সমমর্যাদার ৩ টি পৃথক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেরকম কক্সবাজার, চট্টগ্রাম সহ যেসব জেলায় মাদকের মামলা বেশী সেসব জেলায় শুধুমাত্র মাদকের মামলা গুলো নিষ্পত্তির জন্য আইন করে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। এজন্য দ্রুত বিচার আইনের আদলে বিচার প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করার জন্য বাধ্যবাধকতা রেখে বিধিমালা প্রয়নয় করা যেতে পারে। এতে মাদকের মামলাগুলো আদালত থেকে দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে মাদকের ব্যবসার জন্য অপরাধীরা শাস্তি পেলে সাধারণ মানুষ রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় আর মদক ব্যবসার দিকে যেতে ভয় পেয়ে নিরুৎসাহিত হবে। এছাড়া নাফনদীতে, সীমান্তবর্তী সমুদ্রসীমায় সামুদ্রিক পাহারা আরো বেশী জোরদার ও গতিশীল করা, সীমান্তের পাহাড়ী এলাকায় সম্ভব সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা বিবেচনায়। মাদকের বিরুদ্ধে ধর্মীয়ভাবে সচতেনতা সৃষ্টি করা, সামাজিক ও মানবিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ব্যাপকভাবে। কারণ ইয়াবার করাল গ্রাস যেভাবে সারদেশে মহামারী আকারে ধারণ করেছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে এটার শক্ত ভিত স্বমূলে উৎপাটন করা কখনো সম্ভব নয়।

১০২ জন ইয়াবাবাজ আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের লাভ-ক্ষতি কি হয়েছে-এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে পরিস্কার নয়। আমার ধারণা-আত্মসমর্পনের কারণে রাষ্ট্র বিভিন্ন ভাবে ইতিবাচক ফলাফল পাচ্ছে। আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন ইয়াবাবাজদের মধ্যে অধিকাংশ ইয়াবাবাজ প্রায় একমাস আগে থেকেই পুলিশের হেফাজতে ছিল। সেসুবাধে পুলিশ হেফাজতে থাকাবস্থায় ইয়াবাবাজরা পুলিশকে ইয়াবা ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আরো ৫ শতাধিক ইয়াবাবাজের নাম আত্মসমর্পণকৃত ইয়াবাবাজদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। প্রায় অর্ধশত হুন্ডিবাজের নাম পাওয়া গেছে। যেসব নাম পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ এর আগে জানতোনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তৈরিকৃত ইয়াবাবাজদের ১১৫১ জনের আপডেট তালিকায়ও তাদের নাম নেই। ইয়াবাবাজদের জিজ্ঞাসাবাদে নতুন যাদের নাম এসেছে-তাদের মধ্যে প্রায় একশ’ জন ইয়াবা গডফাদার, ১২ জন মাস্টার হুন্ডীবাজ, গণমাধ্যম কর্মী, জনপ্রতিনিধি, কথিত এলিট পারসন, প্রভাবশালীদের নাম এসেছে। ইয়াবার চালান প্রবেশের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সরকারি একটি বাহিনীর নাম এসেছে। অনেক মুখোশধারী ছদ্মবেশী রতি মহারতির নাম এসেছে। “যারা মানুষের কাছে একেবারে সাধু-আর্থিক সফলতায় তারা ইয়াবা ব্যবসার যাদু” বলে এখন তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাই বাচাই করে বহুমুখী ক্রসচেকের মাধ্যমে একেবারে নিখাদ তথ্য উপাত্ত তুলে আনা হচ্ছে। আবার যারা আত্মসমর্পণ করেছে-তাদের রিমান্ডে এনে প্রাপ্ত তথ্যের ক্রস যাচাইও করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জেনেছি। তাহলে ইয়াবা ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় সব তথ্যই স্বল্প সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চলে আসছে। আবার ১০২ জন ইয়াবাজবাজদের আত্মসমর্পনের কারণে আরো প্রায় শ’খানেক ইয়াবাবাজ আত্মসমর্পনের জন্য সুযোগ খুঁজছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আত্মসমর্পণকারী সকলে মুক্তিপাওয়ার পরও এ ঘৃণ্য পেশায় আর জড়াবেনা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গিয়ে সামজিকভাবে ইয়াবার বিরুদ্ধে সচেতনেতা গড়ে তুলার প্রতিশ্রুতি সহ আরো অনেক বিষয়ে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন। আত্মসমর্পণকৃত ইয়াবাবাজদের ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে গড়ে তোলা অঢেল সম্পদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুদক, সিআইডি’র সংশ্লিষ্ট বিভাগ সহ আরো সরকারি এজেন্সির মাধ্যমে তদন্ত করে বাজেয়াপ্ত সহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসবই ১০২ জন ইয়াবাবাজ আত্মসমর্পণের ইতিবাচক ফলাফল।

আমার নিজস্ব ধারণা মতে, নেতিবাচক যে বিষয়গুলো হচ্ছে, তারমধ্যে আত্মসমর্কৃত ইয়াবাবাজেরা কৃতকর্মে পরিধি অনুযায়ী শাস্তি না পেয়ে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে হয়ত সহজেই বের হয়ে যেতে পারবে। আত্মসমর্পণকারীদের কাছ থেকে পাওয়া কথিত সব অস্ত্র একই ধরনের কেন? পুলিশ হেফাজতে ইয়াবাজেরা থাকাবস্থায় উদ্ধারকৃত ইয়াবাগুলো কোত্থেকে এলো-এ ধরনের আরো কিছু প্রশ্নের জবাব এখনো মিলেনি। যাহোক, এ ধরনের আত্মসমর্পণও দেশের জন্য সর্বপ্রথম ঘটনা হওয়ায় এখানে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। একটা নতুন কর্মজজ্ঞ যখন শুরু হয়-তার ইতিবাচক ফলাফলের পাশাপাশি নেতিবাচক কিছু প্রভাব থাকাটাও অমুলক নয়। তবে আমার ধারণা-১০২ জন ইয়াবাবাজের আত্মসমর্পণের ঘটনায় নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের অর্জন অবশ্যই বেশী। কারণ কথিত বন্ধুকযুদ্ধে কিছু ইয়াবাবাজদের মৃত্যু হয়ে এ প্রকট সমস্যার সামন্য আতংক সৃষ্টি করা গেলেও স্থায়ী সমাধান কোনভাবেই সম্ভব নয়। এতে অনেক ধরণের ক্ষতি রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন গুলো বিচার বহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তুলে, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও সেটা অনুমোদন করেনা ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। সবমিলিয়ে ১০২ জন ইয়াবাবাজের আত্মসমর্পণ ৯ মাস আগে থেকে শুরু হওয়া মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়াশি অভিযানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

গণমাধ্যমের সুবাধে জানা যাচ্ছে-ইয়াবাবাজেরা ইয়াবার চালান ঢুকানোর জন্য এখন নতুন নতুন রুট ও পন্থা আবিস্কার করছে। ইতোমধ্যে উন্মুক্ত প্রায় ৭২ কিঃমিঃ সীমান্তে শক্ত কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার প্রস্তাব এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এমপি মাদক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে হাই কোয়ালিটি সম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন। তিনি সংসদে আরো জানান-গত এক বছরে ৬১৩২৩ জনকে মাদক মামলায় আসামী করা হয়েছে, ১১৯৮৭৮ টি মাদক মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৬৯১২৯৩২৮ পিচ ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার কার হয়েছে, ২৮১৪১ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কক্সবাজার অন্ঞ্চলে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে সার্কেলে রূপান্তর করা হচ্ছে। আত্মসমর্পণকৃত ইয়াবাবাজদের স্বভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের পূণর্বাসনের চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন। দীর্ঘদিনের ইয়াবা নামক অভিশাপ সংক্রামক ব্যাধির মতো রন্দ্রে রন্দ্রে ছেয়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকার জোরালো পদক্ষেপ নিলেও দেশের সর্বত্র গড়ে উঠা এ জগণ্য ব্যবসার বিভিন্ন স্থরে যে বিনিয়োগ রয়েছে তারজন্য, এই জগতের গডফাদারেরা এখন জীবনবাজী রেখে হলেও কারবার চালিয়ে যেতে চাইবে। ইয়াবাসেবনকারীর সংখ্যাও সারদেশে এতই বেড়ে গেছে যে, এ ব্যবসা খুব সহজেই অল্প সময়ের ব্যবধানে শতভাগ নির্মুল করা হয়ত সম্ভব নয়। এই অভিযানকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে এ ভয়াবহ ইয়াবা ও অন্যান্য সব ধরনের মাদকের করাল গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। অগ্রাধিকার দিয়ে নিতে হবে সব যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

(লেখক : এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।)

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

দ্রুত ও স্থায়ী অবসান হোক রোহিঙ্গা সমস্যার

-: তাওহীদুল ইসলাম নূরী :- ২৫ আগষ্ট ২০১৯, রোহিঙ্গা সমস্যার দুই বছর পূর্তি হল। একে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/