সাম্প্রতিক....
Home / জাতীয় / ৫৭ ধারায় ‘বাধাগ্রস্ত’ সাংবাদিকতা, চার মাসে ২৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

৫৭ ধারায় ‘বাধাগ্রস্ত’ সাংবাদিকতা, চার মাসে ২৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরাও। গত চার মাসে কমপক্ষে ২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেশাদার সাংবাদিককে মামলা দিয়ে হয়রানি করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অধিকারকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। বর্তমানে কোনো সংবাদমাধ্যমই অনলাইনের বাইরে নয়। এই আইনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে। সত্য ঘটনা তুলে ধরায় মামলা ও হয়রানি করে নাগরিকের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।

এদিকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিভিন্ন সময় ৫৭ ধারা বাতিলের কথা বললেও এখন পর্যন্ত তা বহাল রয়েছে ও এর অপব্যবহার হচ্ছে। তবে ৯ জুলাই রোববার আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা পরবর্তীতে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তবে মামলার জটিলতায় পড়া সব সাংবাদিককেই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। পেশাদারি কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এসব মামলার বেশিরভাগই করা হয়েছে সংবাদ প্রকাশের পর কিংবা সংবাদ প্রকাশের জের ধরে। আর মামলাগুলো করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

সর্বশেষ ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সহ-সভাপতি ও সকালের খবরের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার আজমল হক হেলালের বিরুদ্ধে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। স্থানীয় স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনে মামলা করেছেন ফারুক হোসেন নামে এক ব্যক্তি। ‍যিনি রুস্তম আলী ফরাজী কলেজের প্রভাষক।

এ মামলার মাধ্যমে কথা বলার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে মন্তব্য করে আজমল হক হেলাল বলেন, ‘৩০ কোটি টাকার কাজ না করে বিল উত্তোলনের অভিযোগে দুটি অনলাইনে খবর প্রকাশিত হয়। তা আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি। এমপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়টিও আমি ফেসবুকে দিয়েছি, কমেন্ট করেছি। এসব কী অপরাধ? ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে তো আমার কথা বলার অধিকারও ক্ষুণ্ণ করা হলো। আমি এ ধারা বাতিলসহ আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

এর আগে গত ৩ জুলাই ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসের কারণে যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার নাজমুল হোসেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে দিনাজপুরে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারায় মামলা হয়৷ জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী হযরত আলী বেলাল বাদী হয়ে মামলাটি করেন৷

সংবাদ প্রকাশের কারণে একই দিনে দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ও সিনিয়র রিপোর্টার তৌফিকুল ইসলাম বাবরের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা করা হয়৷ ২২ জুন ‘খুনের মামলার আসামিরা হাছান মাহমুদের ক্যাডার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এই মামলা করেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ইকবাল হোসেন চৌধুরী৷ তিনি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ হাছান মাহমুদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

১৩ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মুজতবা ধ্রুব’র বিরুদ্ধে মামলা করেন মানিকগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারক মো. মাহবুবুর রহমান। মামলার বাদী অভিযোগ করেন, ‘ওই সাংবাদিক মিথ্যা, বানোয়াট ও অসত্য তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন লেখায় বাদীর মানহানি হয়েছে’।১১ জুন ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা’ শিরোনামে গোলাম মুজতবা ধ্রুব’র তৈরি করা একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

৫৭ ধারায় কী রয়েছে

তথ্য ও যোগোযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, (এক) কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (দুই) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

২০০৬ সালের বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় আইসিটি আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে এর প্রয়োগ কিংবা ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংশোধনীর মাধ্যমে আইনের বড় ধরনের পরিবর্তন আনে।

২০১৫ সালে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেফতার করলে ধারাটি বাতিলের দাবি ওঠে। ৫৭ ধারার অপব্যবহার ও প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়। বিভিন্ন সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই ধারাটি বাতিলের কথা বললেও তার বাস্তবায়ন নেই এবং এ আইনের অপপ্রয়োগে সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ হয়রানি হচ্ছে।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও জ্বালানিবিষয়ক আইনের বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, সমস্যা হচ্ছে ‘ইলেকট্রনিক বিন্যাস’ অংশটুকু নিয়ে, যেখানে মিথ্যা, উসকানিমূলক, মানহানিকর তথ্য ইত্যাদি প্রচারে শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে। ২০০৬ সালে যখন আইনটি করা হয়, তখন বর্তমান সময়ের ফেসবুকসহ এত ইলেকট্রনিক মাধ্যম ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। আগে মামলাটি আমলযোগ্য ছিল না এবং কোনো মামলা করতে গেলে সরকারের অনুমতি প্রয়োজন হতো। এখন তা করতে হচ্ছে না। এতে ঢালাওভাবে মতপ্রকাশের অধিকারকে দমন করতে আইনটির ব্যবহার হচ্ছে।

আইসিটি আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘আইনটি সংশোধন করে শাস্তির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। ফলে প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন মিডিয়ায় একই অপরাধে দুই ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যা সংবিধানের পরিপন্থী।’

তিনি জানান, ফেসবুকে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টিসহ নানান ধরনের অপরাধকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করে তারপর আইনি প্রক্রিয়ায় আনা প্রয়োজন। যেন ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব না হয়।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে মনে করছেন তানজীব উল আলম। তিনি বলেন, কক্সবাজারের রামুতে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাদের বিচার হয়নি। অথচ প্রবীর শিকদারের মতো সিনিয়র সাংবাদিককে জেলে ঢুকানো হচ্ছে এই আইনের মাধ্যমে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সংবাদমাধ্যমে কোনো সংবাদ বা ছবি প্রকাশ এবং ফেসবুকে কোনো সত্য ঘটনা তুলে ধরায় যেসব মামলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বস্তুনিষ্ঠ কোনো সংবাদ প্রকাশে কিংবা ফেসবুকে কোনো সত্য ঘটনা তুলে ধরলে যদি মামলা হয় এবং হয়রানি করা হয়, তাহলে নাগরিকের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।

দায়িত্বশীল কোনো বক্তব্য বা কোনো সত্য ঘটনা যে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করার অধিকার সবার রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশের সময় কেউ যেন দায়িত্বশীলতার বাইরে না চলে যায়, সেজন্যই এ আইন। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে হয়রানি করা হয়, তাহলে সেটা সরকারকে দ্রুত ভাবতে হবে।’

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনাগুলোকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এর মাধ্যমে একজন নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা হচ্ছে না বলেও জানান আইন বিষয়ের এই শিক্ষক।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনকে ‘কালো আইন’ আখ্যায়িত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘বর্তমানে অফলাইনের ব্যক্তিগত কাজের মাধ্যমেও মানুষ অনলাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর অনলাইন ব্যবহারকারীদের মাঝে ভীতি ছড়াতেই মানুষদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এই আইন প্রবর্তন করা হয়েছে। এই কালো আইনের বিলুপ্তির কোনো বিকল্প নেই।’

মূলত ‘শাহবাগ ম্যুভমেন্টের’ পরই এই আইনকে সামনে নিয়ে আসা হয় বলে মন্তব্য করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘শাহবাগ মুভমেন্ট গড়ে উঠেছিল সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে এবং অনলাইনেই এর ডাক দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে যেন শাহবাগের মতো কোনো পাবলিক ম্যুভমেন্ট তৈরি হতে না পারে, কেউ যেন স্বাধীনভাবে অনলাইনে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে না পারে, সেই কারণেই এই আইনকে সামনে আনা হয়েছে।’

‘সরকার কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে মত প্রকাশকে দমন করতেই এই কাজ করছে। এই আইন নিয়ে আপত্তি ওঠার পর সরকার নতুন করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রবর্তন করতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, সেখানে ৫৭ ধারাসহ বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেওয়া হবে, কিন্তু আসলে কী বাদ দেওয়া হবে?’ প্রশ্ন রাখেন এই অধ্যাপক।

৫৭ ধারা বাদের কথা সরকার বললেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্য নামে ৫৭ ধারা থাকবে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। এই বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করেন ফাহমিদুল হক।

কোনো সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে কারও সম্মানহানি হলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কাউকে আইনের আওতায় আনতে আইসিটি আইন অনুযায়ী যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, সেটি প্রিন্ট মিডিয়া বা কাগজে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অনেক পার্থক্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একই কাজের জন্য আলাদা আইন তো হতে পারে না। যদিও সব প্রিন্ট মিডিয়ার এখন অনলাইন ভার্সন রয়েছে। টিভিগুলোও অনলাইনে রয়েছে। সুতরাং এই কালো আইনের বাইরে এখন কেউ নেই। এছাড়াও আইনে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। বর্তমানে এই আইনের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও হচ্ছে।’

ফাহমিদুল হক আরও বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এবং সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে যত মামলা হয়েছে, তার সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেটা সরকার পর্যায়েই হোক আর ব্যক্তি পর্যায়েই হোক।’

মামলা ও হয়রানির মাধ্যমে সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার এই অধ্যাপক বলেন, ‘এই আইন নিয়ে সাংবাদিকদের সোচ্চার হতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।’

অনলাইনে নারীদের হয়রানি রোধে এই আইন কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এখন সর্বসাধারণকে হয়রানি করতে এর ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন সাংবাদিক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসান চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার বাইরে আমরা কেউ না। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য আইন করে এটি এখন উল্টো হয়রানির সৃষ্টি করছে। এর চেয়েও উন্নততর আইন দরকার।’

বর্তমানে কেউ অনলাইনের বাইরে নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন সবাই ডিজিটাল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তির বিধান তো অন্য আইনে রয়েছে, তাহলে কেন আলাদা করে এই আইন?’

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছে এবং পুলিশ জামিন অযোগ্য এই মামলা গ্রহণ করে বিবাদীকে হয়রানি করছে বলে মন্তব্য করেন একসময়ে বিবিসি বাংলায় কাজ করা এই সাংবাদিক।

আফসান চৌধুরী মনে করেন, এই আইনের আওতায় মামলা ও হয়রানির মাধ্যমে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে নাকি কমছে, সরকারের তা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) বলছে, এ ধরনের মামলা বিচার বিভাগ ও সাংবাদিক সমাজের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করবে, যা উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। ১৪ জুন এক বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি শাবান মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় এ ধরনের মামলা সাংবাদিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের মামলায় সংবাদ প্রকাশে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, তা সমাজের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে।

৫৭ ধারা বাতিল না হলে সাংবাদিকতা পেশা হুমকির মুখে পড়বে জানিয়ে এই ‘কালো আইন’ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা। ১৫ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি এই দাবি করেন।

বিতর্কিত এই আইনটি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা থাকছে না। নতুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ আইনে ৫৭ ধারার বিষয়ে পরিষ্কার করা হবে। বর্তমান সরকারের বাক্‌স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার যে কোনো ইচ্ছে নেই, তা এ আইনে প্রমাণ করে দেওয়া হবে।

গত ২ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, নতুন ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন’-এর খসড়া বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং (যাচাই-বাছাই) পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এর অস্পষ্টতা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হবে।

আরও যেসব মামলা

সংবাদ প্রকাশের কারণে ১৪ জুন আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান ও স্থানীয় দৈনিক সময়ের খবর পত্রিকার সম্পাদক কাজী মোতাহার রহমান এবং সময়ের খবরের সাংবাদিক সোহাগ দেওয়ানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

১২ জুন দৈনিক হবিগঞ্জ সমাচার পত্রিকার প্রকাশক এবং হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও জেলা সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি রাসেল চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নীরঞ্জন সাহা নীরুর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়। সংবাদ প্রকাশের কারণে হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খানের ভাতিজা হবিগঞ্জের পাকুরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আফরোজ মিয়া এই মামলা করেন।

৭ জুন সাংবাদিক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে গুলশান থানায় মামলা করেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী৷ মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে যে, আফসান চৌধুরী সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও তার ছেলেকে নিয়ে ফেসবুকে উস্কানিমূলক মন্তব্য করেছেন৷

১৬ মে দি এশিয়ান এজ পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি নিপুন চন্দ্র ও দৈনিক জনতার উপজেলা প্রতিনিধি সঞ্জয় ব্যানার্জীর নামে দশমিনা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ২০১৬ এর ৫৭ ধারার একটি মামলা দায়ের করা হয়। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় দশমিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সিকদার গোলাম মোস্তফা বাদি হয়ে মামলাটি করেন।

২৯ এপ্রিল নতুনসময় ডটকমের সম্পাদক শওগাত হোসেন, নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজু ও ডেইলি শেয়ার বিজ’র নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়াজ মাহমুদ সোহেলকে আসামি করে ৫৭ ধারায় একটি মামলা করা হয়। সংবাদ প্রকাশের কারণে রমনা থানায় তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলাটি করেন ওয়ালটন গ্রুপের আইন বিভাগের সহকারী পরিচালক টিএম আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ।

সংবাদ প্রকাশের জেরে ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান বাদল, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ও নিউজ চ্যানেল ডিবিসি’র সাংবাদিক এবং দৈনিক নারায়ণগঞ্জের আলো পত্রিকার প্রকাশক রাজু আহমেদ, বন্দর প্রেসক্লাবের সভাপতি মোবারক হোসেন খান কমল, সাংবাদিক মাহামুদ হাসান কচি, সিফাত আল রহমানের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে তিনটি মামলা করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ছোট ভাই আলী রেজা রিপন বাদী হয়ে মামলাগুলো করেন।

৩০ মার্চ বাংলাভিশন ও বণিক বার্তার কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি এবং কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের দপ্তর সম্পাদক হাসান আলী ও কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত কুষ্টিয়া দর্পণ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আসলাম আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ফেসবুকে মানহানিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ তুলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলাটি করেন হাসিবুর রহমান রিজু।

১ মার্চ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-এর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোস্তাফিজ মিশুর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মিনারুল ইসলাম।

এছাড়াও এই সময়ের আগে বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।

সিদ্ধান্ত আসছে ৯ জুলাই?

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা থাকছে কিনা এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬’ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসছে ৯ জুলাই রোববার। এ দিন বেলা ১১টায় উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় ২১ সরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সরকারের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের এই সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছে।

গত ১৬ মে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬’-এর ওপর এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সভা আগামী ৯ জুলাই আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। এই সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্প, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র‌্যাব), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, সিআইডি, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (আইসিটি), বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ও বেসিসের প্রতিনিধিদের থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে ওই নোটিশে।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার সব বিভ্রান্তি দূর করা হবে। বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে যাতে কারো মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না থাকে, এ নিয়ে কারও মনে কোনো প্রশ্ন না ওঠে, তা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে পরিষ্কার করা হবে।

আইনমন্ত্রী জানান, মন্ত্রিপরিষদ ইতোমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একটি সভায় এর সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে উপস্থিতরা ‘নতুন আইন’ প্রণয়নের মতামত দিয়েছেন। সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেই সরকারি পর্যায়ের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে।

 

সূত্র:তানজিল রিমন/priyo.com,ডেস্ক।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

ঈদগাঁওর সংবাদকর্মী আবু হেনা সাগরের মাতা অসুস্থ : দোয়া কামনা 

  বার্তা পরিবেশক : কক্সবাজারে ঈদগাঁও উপজেলার সংবাদকর্মী এম আবুহেনা সাগরের মাতা অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের ইবনে ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/