মুকুল কান্তি দাশ,চকরিয়া:
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাবাসী ভাসছে বানের পানিতে। ঘর চাপা ও পানিতে পড়ে শিশুসহ ৪জন মারা গেছে। ঢলের স্রোতে ভেসে গেছে ৭’শ বসত ঘর। আংশিক ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার ঘরের। দু’উপজেলার ১ টি পৌরসভা ও ২৫ টি ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ ঘর-বাড়ী পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ৬ লাখ মানুষ। ঢলের পানি সড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় অভ্যন্তরীন সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে। দু’উপজেলার সরকারী-বেসরকারী অন্তত ৫’শত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বানের পানি প্রবেশ করায় প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠদান অঘোষিত বন্ধ রয়েছে। টানা ৩ দিনের পাহাড়ি ঢল ও পূর্ণিমার প্রভাবে অতি জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে থাকায় খাবার ও পানীয় জলের সংকট তীব্র আকার ধারন করেছে। নৌ-যান সংকটের কারণে শুকনো খাবারও সংগ্রহ করতে পারছে না প্লাবিতরা ।
বন্যায় নিহতরা হলেন-ঢলের স্রোতে ঘর ভেঙ্গে পড়ে চকরিয়ার উত্তর মানিকপুরে মৃত আবদুস সালাম প্রকাশ আবদুল্লাহর ছেলে আনোয়ার হোসেন (৫০), পৌরসভার ৪নং ওয়াডস্থ ভরামুহুরীর ভাড়াটিয়া জাহাঙ্গীর আলমের ১ বছর বয়সি শিশু ছেলে আলভী হোসেন (১) পানিতে পড়ে, খুটাখালীর ৮নং ওয়ার্ডে ইউছুফ আলীর মেয়ে রোকেয়া খাতুন (২৫) মাটির ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে মারা গেছে। বন্যায় এই ৩জন মারা যাওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম ও পিআইও আহসান উল্লাহ ।
অপরদিকে, সোমবার দুপুরে উজান থেকে ঢলের পানিতে ভেসে আসা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের এক অজ্ঞাত মহিলার লাশ চকরিয়ার মানিকপুরের বাসিন্দারা উদ্ধার করে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছে। ধারনা করা হচ্ছে ঢলের পানি থেকে লাকড়ী সংগ্রহ করতে গিয়ে পার্বত্য উপজেলা লামা থেকে ওই মহিলা ভেসে আসতে পারে।
চকরিয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহাসান উল্লাহ বলেন, চকরিয়া পৌরসভা ও ১৮ ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের সাথে মনিটরিং এর মাধ্যমে বন্যার খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। সরকারী ত্রাণ না আসায় জিআর বরাদ্দের ৪০ মেট্রিক টন চাউল প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় বরাদ্দ করে দেয়া হয়েছে। জরুরী ত্রাণ বরাদ্দ পেতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। তিনি চকরিয়ার ৮০ শতাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরো বলেন গত তিন দিনে নদী তীরবর্তী অন্তত ৫’শ ঘর স্রোতে ভেঙ্গে ও ভেসে গেছে। আরো কয়েক হাজার ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ঢলের পানি নামলেই রাস্তাঘাটসহ ক্ষতির পরিমান জানা যাবে।
অপরদিকে, পেকুয়ার পিআইও অফিসের সহকারী ওমর আলী বলেন, এ উপজেলার ৯০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে রয়েছে। অন্তত ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী এখনো। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ২’শ বসতঘর সম্পূর্ণ ও কয়েক হাজার ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। পানি নেমে গেলে বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপন করা হবে।
এদিকে, অতিরিক্ত প্লাবিত হওয়ায় দু’উপজেলার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ স্কুল ভবন, সাইক্লোন সেল্টার ও পাহাড়ে আশ্রয় নিলেও বসত ঘর ও মালামাল খোওয়ানোর ভয়ে প্লাবিত অন্তত সাড়ে ৫ লাখ মানুষ জীবন ঝুকি নিয়ে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্লাবিত ইউনিয়নগুলো হলো, চকরিয়ার বুমবিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, ফাঁসিয়াখালী, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, ঢেমুসিয়া, বদরখালী, চিরিংগা, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, কোণাখালী চকরিয়া পৌরসভা ও পেকুয়ার সদর, মগনামা, উজানটিয়া, শিলখালী, বারবাকিয়া, টৈটং, রাজাখালী। প্লাবিত ইউনিয়গুলোর মধ্যে উজানের পাহাড় ঘেষা এলাকায় পাহাড়ি ঢল ও উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় মাত্র ১ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বানের পানি সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিলো।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে বন্যা কবলিত এলাকায় খাবার ও পানীয় জলের জন্য আহাজারীর পাশাপাশি পুরো বসতঘর নিমজ্জিত পরিবারের সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে কান্নাকাটি করছিলো বলে এলাকাবাসী জানায়।
কাকারার এসএমচরের বাসিন্দা মাস্টার তৌহিদ বলেন, ঘরের ভিতর অন্তত ৬ ফুট উচু পানি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সিলিং-(দমদমা) এ অবস্থান করছি। রান্না করতে না পারাই তিন দিন ধরে পরিবারের কেউ খাবার খাইনি। পানীয় জলও পাচ্ছি না টিউবওয়েল ডুবে থাকায়। সাঁতার কেটে স্টেশনে যাচ্ছি শুকনো খাবার কিনে আনতে। একই অভিমত গৃহবধু রেহানা, উত্তরপাড়ার শহীদুল্লাহ , পূর্ব পাড়ার খালেদসহ পানিবন্দী অসংখ্য পরিবার সদস্যের।
লক্ষ্যারচরের মকসুদ আহমদ বলেন, আল-মোস্তাফা এতিমখানার শতাধিক এতিম শিশু সড়কের উপর মানবেতর অবস্থায় রয়েছে। চকরিয়া কলেজ, আমজাদিয়া মাদ্রাসাসহ উপজেলার সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢলের পানি প্রবেশ করায় পড়া-লেখা বন্ধ হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্যারচর ইউপি চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মানিক বলেন, আমার ইউনিয়নের সকল বসতঘরে পানি উঠেছে। বেশীরভাগ পরিবার সদস্য উপোস রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২ টন চাউল বরাদ্দ দেয়া হলেও খাদ্য গুদামের বাইরে পানি উঠায় ওই চাউল আনা সম্ভব হয়নি। তাই ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খিচুড়ি রান্না করে সড়কে আশ্রয় নেয়া নারী-পূরুষদের খাবার দিচ্ছি।
You must be logged in to post a comment.