অজিত কুমার দাশ হিমু, কক্সভিউ:
চরম ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। সেই সাথে কঠিন হুমকির মুখে পড়েছে মূল্যবান ঝাউবীথি। ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এ সমুদ্র সৈকতে গত চার দশকে ভাঙ্গন এবং নিধনের শিকার হয়ে প্রায় ৬ লাখেরও বেশী ঝাউগাছ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে একসময় হয়তো হারিয়েই যাবে দেশের বড় একটি অংশ। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে তলিয়ে যাবে দেশের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ উপকূলীয় এলাকা। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই দেশকে তাই নিতে হবে কার্যকর কৌশল। এমনটাই বলছেন পরিবেশবিদরা।
সৈকতের বালিয়াড়ীর ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় সমুদ্র সৈকত হারাচ্ছে সৌন্দর্য, অন্যদিকে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে সমুদ্র সৈকত সহ ভ্রমণপিপাষু পর্যটক এবং পর্যটন শহরের মানুষ। পাশাপাশি হুমকীর মুখে পড়েছে সৈকতের জীব বৈচিত্র।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্টে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ঢেউয়ের তীব্রতাও বেড়ে গেছে এবং সৈকতে পর্যটকদের অবাধ বিচরণ এবং কিছু দুস্কৃতকারী লোকজন সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে লতা পাতা, ঝাউগাছ কেটে নিয়ে যাওয়ায় কারণে এ অবস্থার হেেচ্ছ।
তিনি বলেন, সমুদ্র সৈকতে বালিয়াড়িগুলোকে অনেক আঁকড়ে ধরে রাখে সৈকত লতা, নিশিন্দাসহ গুল্ম জাতীয় লতা বা ঝাউগাছগুলো। কিন্তু দিন দিন এসব লতা পাতা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রে সৈকতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভাঙ্গনের কারণে একদিকে সৈকতের সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে সাগর লোকালয়ের কাছে চলে আসায় কমে আসছে মূল ভুখন্ড। এছাড়াও স্বাভাবিক সৈকত না থাকলে সামুদ্রিক কচ্ছপ, লাল কাঁকড়াসহ প্রাণীকুল আবাসস্থল হারাচ্ছে। এতে করে হুমকির মুখে পড়ছে জীব বৈচিত্র ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ১২০ কিলোমিটার সৈকতের পাশে সবুজ বেষ্টনির মত দাঁড়িয়ে আছে ঝাউগাছ ও পাহাড়। সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি পর্যটকদের অসাধারণ সৌন্দর্য্যরে হাতছানি দিচ্ছে এ ঝাউ বাগান ও পাহাড়। কিন্তু সাগরের করাল গ্রাসে শহরের ডায়বেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট, নাজিরারটেক, চর পাড়া, সমিতি পাড়া, শৈবাল পয়েন্ট থেকে লাবনী পয়েন্ট, কলাতলী মেরিন ড্রাইভ রোড পর্যন্ত ঝাউ বাগানে নেমে এসেছে এই মহা বিপর্যয়। গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র এসব এলাকায় বিলীন হয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার গাছ সহ বহু স্থাপনা। এ ছাড়াও পর্যটন স্পট হিমছড়ি, প্যাঁচারদ্বীপ,ইনানীসহ টেকনাফ পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে ভাঙ্গন, নিধন এবং দখলের কবলে পড়েছে ঝাউবাগান।
স্থানীয় ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলার এস.আই আক্তার কামাল জানান, ৯১’র প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্ষায় ভাঙ্গন আরো বেড়ে যায়।
স্থনীয় অধিবাসীরা জানান, ডায়াবেটিকস পয়েন্ট থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত অব্যাহত ভাঙ্গনে গত দুই বছরে স্থানভেদে এক কিলোমিটারেরও বেশী বালিয়াড়ি ও ঝাউবাগান বিলীন হয়ে গেছে।
অন্যদিকে এসব ঝাউবাগান দখল করে সেখানে অবৈধ বস্তি গড়ে তোলায় দিন দিন সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম এ সমুদ্র সৈকত। শুধু দখল নয়, এসব অবৈধ দখলদারদের শিকারে পরিণত হয়ে প্রতিদিন নিধন হচ্ছে শত শত ঝাউগাছ।
বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কক্সবাজার সৈকতজুড়ে প্রায় সাতলক্ষ চারা রোপন করা হয়। কিন্তু ভাঙ্গন এবং গাছ খেকোদের দ্বারা গাছ নিধনের কারণে বর্তমানে গাছের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজারে। এতে উদ্বিগ্ন বন বিভাগও।
তবে কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যেসব এলাকাগুলোতে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে অবস্থানগত কারণে সেখানে হয়তো আর চারা লাগানো যাবেনা। তবে বরাদ্দ আসলেই আরো নতুন নতুন জায়গায় বনায়ন করা হবে।
এদিকে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস এবং ভাঙ্গন থেকে কক্সবাজারকে রক্ষার জন্য কক্সবাজার শহর রক্ষা বাঁধ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কলাতলী বেইলী হ্যাচারী থেকে শুরু করে কলাতলী সৈকত, লাবনী পয়েন্ট, শৈবাল পয়েন্ট, ডায়বেটিক হাসপাতাল, পুরাতন বিমান বন্দর থেকে নুনিয়ারছড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং দুই কিলোমিটার অংশে বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক কাজ, বেশ কয়েকটি পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ প্রকল্পে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে একশো কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
You must be logged in to post a comment.