এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও :
সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও মানুষ। ওদেরও স্বপ্ন আছে, অন্য দশ বন্ধুদের সাথে সেজে গোজে পরিপাঠি হয়ে ঈদের দিন ঈদের ময়দানে নামাজ শেষে বন্ধুদের সাথে খুশির আমেজে দিনটি পার করার। কিন্তু কক্সবাজার সদর উপজেলার বৃহত্তর ঈদগাঁওতে ওদের অবস্থান ভিন্ন চিত্রে।
ঈদগাঁও বাজারের বিভিন্ন অলিগলিতে ঘুরে ফিরে পথকলি শিশুরা একত্রিত হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ব্যবসায়িক ভরা মৌসুমে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন মার্কেটে আদরের সন্তানদের নিয়ে পিতা-মাতারা অধিক আগ্রহ করে ঈদের কেনাকাটা সারছে। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কারো নেই পিতা আবার কারো মাতা।
পথকলি এসব শিশুরা পথে প্রান্তরে বেড়ে উঠে। তাদেরও আসন্ন খুশির ঈদে মেতে উঠার স্বপ্ন রয়েছে। এমনকি অনেকে এসব অসহায় শিশুদের কাছে টেনে নিয়ে বুকে আঁকলে ধরে নতুন জামা কিংবা তার সম-পরিমাণ অর্থ দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেকে এদের দেখলে তিরস্কারও করে। এ হচ্ছে পথকলি শিশুদের জীবন যাত্রা। তারা সঠিক ভাবে পিতা-মাতা কিংবা আত্মীয় স্বজনদের আদর সোহাগ আর শাসন থেকে বঞ্চিত। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জনসমাগম স্থানে এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিক্তবানদের ব্যক্তিগত উদ্যেগে সুবিধা বঞ্চিত কিংবা পথকলি শিশুদের মাঝে ঈদের পোষাক বিতরণ করলেও জেলা সদরের গুরুত্ববহ বানিজ্যিক নগরী বৃহত্তর ঈদগাঁওতে এখনো পর্যন্ত পথকলি শিশুদের পার্শ্বে মানবিক সহায়তায় কেউ দাঁড়ায়নি। তবে সচেতন মহলের মতে, পথকলি শিশুদেরকে অবহেলা না করে, আপন করে নিয়ে সন্তানদের মত করে ঈদের খুশির আমেজকে ভাগাভাগি করার আহবান জানানো হয়।
ফুলের জন্য যেমন রয়েছে বাগান, তেমনি শিশুদের জন্য রয়েছে নিরাপদ মাতৃক্রোড় কিংবা সংশ্লিষ্ট শিশুর পরিবার যেখানে সঠিক পরিচর্যায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে ওরা প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু প্রত্যেক ফুল বাগানে ফোটার আর প্রত্যেক শিশু মায়ের তত্ত্বাবধানে সুন্দর পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ হয় না। পথকলিরা হচ্ছে সমাজে সেসব ছিন্নমূল সম্প্রদায় যারা অনিশ্চিত ভবিষ্যত মাথায় নিয়ে বৃহত্তর এলাকার পথে প্রান্তরে বেড়ে উঠছে। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শিশু বয়স হতেই যাদের হাতে কাগজ কুড়াবার বস্তা শোভা পায় কিংবা রাস্তার ধারে ইট ভাঙ্গা, কুলির মত পণ্য বোঝাই এবং চায়ের দোকানে খেয়ে পড়ে চাকরি বা ভিক্ষার থলে হাতে নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যাদের জীবন চলে তারাই একমাত্র হতভাগ্য সম্প্রদায়। এদের অন্য ভাষায় বলা হয় টোকাই। টোকাইদের বসবাস মূলত ফুটপাত কিংবা ব্যস্ততম বাজারের অলিগলিতে। অবস্থার কারণে ওরা অত্যন্ত নিম্ন ও নোংরা পরিবেশে জীবন-যাপন করে। এমনকি অধিকাংশ টোকাইদের দু’বেলা খাবারও জুটে না। অনাহারে অর্ধাহারে, জীর্ণ-শীর্ণ দেহমন নিয়ে ওরা সারাদিন বৃহত্তর ঈদগাঁওর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কিংবা বাজার এলাকার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অনেক সময় বিত্তবানদের ফেলে দেওয়া কুড়াতে ডাস্টবিনের আশপাশেও চোখে পড়ে। যে বয়সে ওদের পাঠশালায় শিক্ষার্থী হওয়ার কথা। এদের মাঝেও স্বপ্ন ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় বড় হবার। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পূরণে কেউ স্বপ্নের দূত হয়ে এগিয়ে আসছে না। সবকিছুর পরিবর্তন হলেও অপরিবর্তিত রয়ে যায় পথকলিদের ভাগ্য। এক প্রকার জীবন যুদ্ধে শিশুরা। অভাবের তাড়নায় বাঁচার তাগিদে পথকলি শিশুরা নেমেছে রাস্তায়।
জেলাজুড়ে নানা উপজেলায় প্রায়শঃ বাড়ছে শিশু শ্রম। মূলতঃ হরেক রকম ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান কোমলমতী শিশুদের অর্থের প্রলোভনে ফেলে শিশুদের মরণাক্তক ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত করছে এবং করেই চলছে। এক পর্যায়ে কারণে-অকারণে শিশুদের ভাগ্যে জোটছে শারীরিক, মানষিক ও শোষণ সহ নানা ধরণের নির্যাতন। কখনো আবার বৈষম্যের শিকার ও হচ্ছে। অভাবের তাড়না ও সংসারের অশান্তির কারণে পথকলি শিশুরা বাঁচার তাগিদে জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়ে রাস্তায়। এক সময় পথভ্রষ্ট হয়ে চলে যায় টাকার রাজ্যে। ছোট্ট বয়সে সংসারের হাল ধরতে নেমে পড়ে জীবন যুদ্ধে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বর্তমানে শ্রম বাজারে জেলার বিভিন্ন স্থানে কোমলমতী শিশুদের শ্রমকাজে খাটাচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মালিক পক্ষ। বলতে গেলে, শোষকের কাজে শিশু শ্রম বিশেষ করে নিম্ন বিত্তদের দারিদ্রের অন্তরালে সংসারের অভাব, দারিদ্রতা এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হয়ে যাওয়ায় উক্ত পরিবারের সদস্যরা শিক্ষা বঞ্চিত অজ্ঞ অভিভাবকদের আর্থিক সুবিধা ক্ষুধার রাজ্যে যুদ্ধ করে এক প্রকার বাধ্য হয়ে পড়ে প্রলোভনে লোভনীয় প্রস্তাবের বিনিময়ে ঐসব কোমলমতী শিশুরা শিক্ষার বই-খাতা-কলমের পরিবর্তে নিরুপায় হয়ে ঢুকে পড়ে শ্রম জগতে। সু-শিক্ষার ধ্যান, ধারণা ও বিদ্যালয়ে যাওয়ার মনমানষিকতা থাকলেও অভাব হয়ে উঠে সবচেয়ে বড় বাঁধা। ফলে এসব শিশুরা এখন শিক্ষার কাছ থেকে পরাজিত হয়ে দারিদ্রের কাছে ঝুঁকছে।
জেলা সদরসহ উপজেলা জুড়ে অধিকাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ মরণ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। অবুঝ শিশু-কিশোররা লবণের মাঠ, বিষের দোকান, শুটকি মহল, ইটভাটায় ইটভাঙতে, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া নৌকায় ভাত রান্না করার কাজে, ওয়ার্কসপে ওয়েল্ডিং করার কাজে, কিটনাশক বিক্রির দোকানে, হোটেল রেস্তোরায়, সাগরে পুনা আহরণ, মাছ বিক্রি, ঝিনুক বিক্রি, হরেক রকম যানবাহন চালনাসহ কঠিন নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায় প্রায়শঃ।
ক’জন শিশু শ্রমিকের সাথে কথা হলে জানায়- কাজ করার পরেও তেমনি পারিশ্রমিক হিসাবেও মজুরী পায় সন্তোষজনক। এনিয়ে পরিবার চলাতো দুরের কথা, নিজেও চলা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান। এভাবে আর কতকাল? একটি অসাধু মহল প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলের কচি-কাঁচা পথকলি শিশুদের ঝুকিপূর্ণ কাজের মত হীনকাজে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠছে। আবার অনেকে এ কাজ ছেড়ে অন্যকাজে চলে যাচ্ছে বলেও জানায়। পক্ষান্তরে কাগজ কুড়ানো, বেকারী, ফেরীওয়ালা, যানবাহনের হেলপারের কাজে নিয়োজিত করেছে এক শ্রেণীর কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল। এছাড়া মরনাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করতে গিয়ে দূর্ঘটনায় শিকার হয়ে অনেকেই অকালেই ঝরে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আবার অনেকে পঙ্গুতের অভিশাপ নিয়ে জীবন-যাপন করছে। শিশু অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নানা ব্যানারে একাধিক সংগঠন কাজ করলেও তা থাকে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
এ ক্ষেত্রে শিশুরা শ্রমের পাশাপাশি নির্যাতনে ও শিকার হচ্ছে। এমনকি শারীরিক, মানষিক ভাবেও আক্রান্ত হচ্ছে। বতর্মানে জেলা-উপজেলা জুড়ে প্রধান সমস্যা রোহিঙ্গা শিশু।
স্থানীদের মতে, এসব রোহিঙ্গা শিশুদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি শিক্ষা বঞ্চিতদের জন্য স্কুলে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। তা না হলে মহা মনীষিদের কথায় প্রমাণ মিলবে না- “আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ”। একটি অনিশ্চিত প্রজন্ম এ পথকলি। এদের রক্ষায় এগিয়ে আসার দায়িত্ব সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের।
You must be logged in to post a comment.