সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / সাম্প্রতিক... / ঐতিহ্য হারাচ্ছে ঈদগাহ হাইস্কুল : খেলার মাঠে এবার বহুতল ভবন : মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ঐতিহ্য হারাচ্ছে ঈদগাহ হাইস্কুল : খেলার মাঠে এবার বহুতল ভবন : মিশ্র প্রতিক্রিয়া

এম আবুহেনা সাগর; ঈদগাঁও :

কক্সবাজার সদরের ঐতিহ্যবাহি ঈদগাহ হাই স্কুলের বিশালকার মাঠটি কোন রকমে তার অর্ধেক অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেই অস্তিত্বের অবশিষ্ট অংশের উপর স্কুল কর্তৃপক্ষ এবার বহুতল ভবণ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রস্তাবিত ওই বহুতল ভবণটি নির্মিত হলে বৃহত্তর ঈদগাহ অঞ্চলে উন্মুক্ত খেলার মাঠ বলে কিছুই থাকবে না।

বিশ্বস্থ সূত্র মতে, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অর্থায়ণে ৪কোটি টাকা ব্যয়ে ৪তলা বিশিষ্ট ভবণটি নির্মাণ করছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। স্কুলমাঠের উত্তরপার্শ্বস্থ শহীদমিনারের পাশে ১১৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৪২ ফুট প্রস্থের ওই ভবণটি নির্মাণের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। যা বিদ্যমান খেলার মাঠের প্রায় অর্ধেক স্থান দখল করে নিবে।

ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা ভবণটি নির্মাণের জায়গা পরিমাপ করে মাটি পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে প্রেরণ করেছে বলে ওই সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

জানা যায়, কালের সাক্ষী বাংলার সুবেদার মুঘলপুত্র শাহ সুজার স্মৃতি বিজড়িত ঈদগাহ ময়দান, ঈদগাহ হাইস্কুল মাঠটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এই বৃহত্তর ঈদগাহ অঞ্চলের ধর্মবর্ণগোত্র নির্বিশেষে সমস্ত গণমানুষের আনন্দ-বেদনার সার্বজনীন উৎসব, মেলা-পার্বন, খেলাধুলা, শিল্প-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক সভার একমাত্র মিলনকেন্দ্র। গত ৩ শত বছর ধরে ওই মাঠটি এই জনপদের লক্ষ মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীলতা বিকাশের তীর্থভূমি হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। এই স্কুল মাঠের ধূলি ও কাদাজল মেখে বড় হয়েছে দেশবরেণ্য মনীষি, কবি সাহিত্যিক–সাংবাদিক, শিক্ষক, আমলা, গবেষক,আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী, সেনাকর্মকর্তা, জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাংসদ, জাতীয় ফুটবলার’সহ অসংখ্য আলোকিত মানুষ। সেই মাঠের প্রাকৃতিকতা ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে ভবণ নির্মাণ স্কুলকর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শি ও গণবিরোধি সিদ্ধান্ত বলে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

প্রাগৈতিহাসিক সুত্রমতে, মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজা সিংহাসন দখলের ভ্রাতৃযুদ্ধে পরাজিত হলে তাঁর অনুগত সৈন্যসামন্তসহ আরাকান অভিমুখে যাত্রাকালে তৎকালীন নয়াবাদ (ঈদগাহ) অঞ্চলের ফুলেশ্বরী নদীর এই সমতল বেলাভুলিতে (বর্তমান মাঠ) ঈদের নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে মুঘলপুত্র শাহসুজার স্মৃতি বিজড়িত ওই নয়াবাদ, ঈদগাহ নামে সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় এগিয়ে যায়।

১৯২৮ সালে কক্সবাজার চৌফলদন্ডীর প্রজাহিতৈষী জমিদার খাঁন বাহাদুর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ অঞ্চলের সাধারণ শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্য ঈদগাহ হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ২ একর ৮ গন্ডা ৩ কড়া জমি দান করেন। যা ৫১নং ওয়াকফনামা মুলে ঈদগাহ হাইস্কুলের নামে ১৫/০১/১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে রেজিস্ট্রি হয়। স্কুলের খেলার মাঠ দখল করে বহুতল ভবণ নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ক্রীড়া ও সংস্কৃতিপ্রেমী যুবসমাজ, অভিভাবক, সচেতন নাগরিক সমাজসহ সর্বমহলে গভীর উদ্বেগ ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যা দিনদিন চাপা ক্ষোভ ও গণরোষে পরিণত হচ্ছে।

খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া বা ইজারা বা অন্যকোনভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না। কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লংঘন করিলে অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসরের কারাদন্ড বা ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডেনীয় হইবে। স্কুলমাঠে বহুতল ভবন নির্মাণ বিষয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনবিদ ইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম বলেন, ঈদগাহ হাইস্কুলের মাঠ বৃহত্তর ঈদগাঁওর ফুসফুস। এটি দখল করে বা সংকোচিত করে ভবণ নির্মাণ কোনক্রমেই শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। যারা এইরুপ গণবিরোধী কার্যক্রমের সম্পৃক্ত তারা ঈদগাঁওর গণমানুষের শত্রু। এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই ঈদগাঁওর জনগণ মেনে নিবেনা। এই সিদ্ধান্ত থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে এসে শিক্ষা ও প্রকৃতিবান্ধব সিদ্ধান্তগ্রহণ করবে ততই সকলের মঙ্গল।

কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নোমান হোসেন প্রিন্স বলেন, স্কুলের মাঠ ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ স্পষ্টতই পরিবেশ ও শিক্ষাবান্ধব উন্নয়ন নয়। এটি যেহেতু শিক্ষামন্ত্রনালয়ে প্রকল্প সেহেতু ইতিবাচক বিকল্প প্রস্তাব বা সমাধান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেই খুঁজে বের করতে হবে। নয়তো শিক্ষামন্ত্রনালয়ই শুধু পারে এই প্রকল্প বাতিল করে মাঠ সংরক্ষনের ব্যবস্থা নিতে। ঈদগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছৈয়দ আলম বলেন, এমনিতে ঐতিহ্যবাহি ঈদগাহ হাই স্কুলের মাঠটি অস্তিত্বসংকটের মুখে মুমূর্ষু অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তার উপর উন্নয়নের নামে বিষাক্ত থাবা। এটা কোন ক্রমেই টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পনা নয়। যা বর্তমান সরকারের নীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থি কাজ। যেকোন মূল্যে এই মাঠ আমাদের রক্ষা করতে হবে।

স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহমুদুল করিম মাদু বলেন ,ঈদগাহ হাইস্কুলের উন্নয়নের স্বার্থে অনেক চেষ্টা করে একটি বড় প্রকল্প পাওয়া গেছে। স্কুল মাঠের একাংশ ব্যবহার করা ছাড়া ভবন নির্মাণের বিকল্প জায়গাও নেই।

স্কুলমাঠে বহুতল ভবণনির্মাণ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক খুরশীদুল জান্নাতের সাথে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

স্কুলের নবনিযুক্ত সহকারী প্রধান শিক্ষকের মতে, স্কুলমাঠে ভবণ নির্মাণের প্রকল্প সম্পর্কে তিনি শুনেছেন, তবে বিস্তারিত জানতে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন।

ঈদগাঁও ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, খেলার মাঠে ভবন নির্মান না করার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আহবান জানান।

মিডল কক্সের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক হাসান তারেক জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে পুরাতন ঝুকিঁপূর্ণ ভবনটি ভেঙ্গে প্রস্তাবিত নতুন বহুতল ভবনটি নির্মাণ করতে পারে।

খেলার মাঠে ভবণ নির্মাণ করে খেলাধুলা বা শিশু-কিশোরদের চিত্তবিনোদন এবং শারীরিক- মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা কিংবা স্থাপনা নির্মাণ করে পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরোধী কর্মকান্ড সুনির্দিষ্ট যেমন আইনের লংঘন তেমনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টির পাশাপাশি সর্বমহলে হতাশারও জন্ম দিবে।

ঐতিহ্যের সাক্ষী মাঠটি রক্ষা করতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।

 

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

https://coxview.com/wp-content/uploads/2024/05/Khorshida-Jannat-Sagar-14-5-224.jpeg

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফাহমিদা বেগমের সাথে ঈদগাহ হাই স্কুল প্রধান শিক্ষকের সাক্ষাৎ 

  এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, কক্সবাজারের উপ-পরিচালক ফাহমিদা বেগমের সাথে ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/