থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচকে উদ্ধারে প্রস্তুতি চলছে কয়েক দিন থেকেই। ৬ জুলাই শুক্রবার উদ্ধার অভিযানে থাকা শত শত সেনা, সেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের হৃদয় ভেঙে দেওয়া খবরটি শুনতে হলো। গুহার ভেতরে কিশোরদের অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে নিহত হয়েছেন সাবেক থাই নেভি সিলের সদস্য গুনান, যিনি এ ১২ কিশোরের দুর্ভাগ্য দেখে নিশ্চুপভাবে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। বাধ্যবাধকতা না থাকলেও হৃদয়ের তাড়নায় এসে যোগ দিয়েছেন উদ্ধার অভিযানে।
গুনানের মৃত্যু সবাইকে বাস্তবতাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ১২ কিশোরকে নিরাপদে গুহা থেকে বের করে আনা কতটা দুরূহ কাজ, গুনান তা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
খুদে ফুটবলার ও তাদের কোচের গুহার মধ্যে এভাবে আটকে পড়ার ঘটনা থাইল্যান্ডবাসীকে কাঁদিয়েছে, আবেগের সাগরে ভাসিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ ঘটনাটি থাইল্যান্ডবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, মানুষের প্রতি তাদের ভাতৃত্ববোধ, হৃদ্যতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আটকে পড়া কিশোরদেরকে তারা নিজেদের পরিবারের সদস্য মনে করতে শুরু করেছেন।
১২ কিশোর ৯ দিন ধরে নিখোঁজ থাকায় থাইল্যান্ডবাসী যখন শোকে মুহ্যমান, তখনই কিশোরদেরকে জীবিত খুঁজে পাওয়ার খবর আসলো তাদের কাছে। এ খবরেও তাদের কান্না থামেনি। তবে গত ৯ দিনের কান্নার চেয়ে এ কান্না আলাদা। এটা তো অানন্দাশ্রু!
থাম লুয়াং গুহাটি স্থানীয়দের কাছে খুবই পরিচিত। মেয়াসাই জেলা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরত্বে এটির অবস্থান। যে কিশোররা গুহার ভেতরে আটকা পড়েছেন, তাদের কাছেও এটি পরিচিত ছিল। কিশোররা সবাই একই ফুটবল দলের সদস্য এবং একই গ্রামের বাসিন্দা। খেলা শেষে প্রায়ই ওই গুহায় ঘুরতে যেত তারা।
গুহায় আটকে পড়া কিশোরদের মধ্যে একজন ছিলেন পাটচারি খুমগেন নামের এক দোকানির পরিচিত। তিনি বলেন, ‘পরিচিত কেউ গুহার মধ্যে এভাবে আটকে থাকুক, এটা কেউ চাইবে না। ও খুবই ভালো ছেলে, খুবই মিশুক এবং মজা করতে পছন্দ করত। মাত্রই কৈশোরে পা দিয়েছে ও, কিন্তু এখনই ওকে দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম লাগে। খুব ছোটবেলা থেকেই ওকে এবং ওর পরিবারকে চিনি আমি।’
পাটচারি এখন নিজের ব্যবসা বাদ দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের জন্য স্টিকি রাইস ও ফ্রায়েড পর্ক রান্না করেন। এ দুটি খাবার থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যে খুবই জনপ্রিয়। কারও প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে থাইল্যান্ডবাসী এ খাবারটি খাওয়ায়।
বান পা মুয়াট স্কুলের কাছে উদ্বিগ্ন অবস্থায় বসে ছিলেন শিক্ষক বুনচব চাই-আর্ম। গুহায় আটকে পড়া কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছেলেটি তার অনেক দিনের পরিচিত। ছেলেটির ডাকনাম মার্ক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মার্ককে পড়িয়েছিলেন বুনচব। তিনি জানান, মার্ক খুবই চনমনে ও মিশুক প্রকৃতির ছেলে। প্রাথমিক পার হলেও মার্কের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার।
এখন মার্ক ও তার বন্ধুদের কথা ভেবে নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছেন এ শিক্ষক। স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছেই প্রথম এ ঘটনাটি শুনছেন তিনি। একদিন শিক্ষার্থীরা এসে তাকে টিভি চালু করতে বলে এবং টিভি চালু করে খবরটি শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি।
বুনচব বলেন, ‘অল্প কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে আসে। অন্যরা সারা দিন টিভিতে উদ্ধার অভিযানের খবর দেখে।’
এরই মধ্যে স্কুলটি আটকে পড়া কিশোরদের পরিবারকে অর্থ ও খাবার সহায়তা দিচ্ছে। এসব পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তানদের চিন্তায় কাজে যোগ দিতে পারছে না।
কিশোরদের আটকে পড়ার ঘটনাটি পুরো জনপদকেই ঐক্যবদ্ধ করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছোট্ট জনপদটি এখন লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার সাংবাদিক, উদ্ধারকর্মী ও উৎসুক জনতার জন্য নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছেন তারা।
স্থানীয় একজন নারী কয়ইউলাই প্রমউইজিত বলছিলেন স্থানীয়রা কীভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে সবাই প্রতি মুহূর্তে কিশোরদের আটকে পড়া নিয়ে কথা বলছে। গ্রামবাসীরা শত শত প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে।’
স্থানীয় একটি সেলুনের এ কর্মী জানান, নিজের কাজ বাদ দিয়ে তিনি এবং তার বোন অতিথিদের জন্য খাবার তৈরি করেন। এমনকি অতিথিদের যেন বেশি করে খাবার দিতে পারেন, এ জন্য নিজেরাও কম করে খাচ্ছেন।
কিশোরদের জীবিত পাওয়ার মুহূর্তটির কথা স্মরণ করে কয়ইউলাই বলেন, ‘আমি শুতে যাচ্ছিলাম, তখনই এ খবরটি শুনতে পাই। সারা রাত আর ঘুমাতে পারিনি।’
চিয়াং রাই প্রদেশের এ ছোট্ট গ্রামের বাসিন্দারা বাড়তি লোকজনের ভিড় যেভাবে নিজ দায়িত্বে সামলাচ্ছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের প্রতিটি কাজেই যেন থাকে ওই কিশোরদের জন্য প্রার্থনা। অতিথি সেবাকেও তারা কিশোরদের জন্য প্রার্থনার অংশ হিসেবেই মনে করছে।
গ্রামের টয়লেটগুলোর দিকে তাকালেই তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যাবে। বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পরিবেশ ও হাজার হাজার মানুষের ভিড়েও টয়লেটগুলোকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন গ্রামবাসীরা।
ভারী শ্রিচাই একজন কৃষক। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিশোররা উদ্ধারের আগ পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানস্থলে থাকবেন এবং অতিথি সেবা করবেন। তিনি টয়লেটগুলো পরিচ্ছন্ন রাখছেন। গ্রামবাসীরা টয়লেটে ঢোকার আগে আলাদা কলের ব্যবস্থা করেছে। যাতে মানুষ কর্দমাক্ত পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে।
এ রকম শত শত ভারী শ্রিচাইয়ের দেখা মিলবে উদ্ধার অভিযানে। তারা সবাই নিজেকে এ উদ্ধার অভিযানের অংশ বলে মনে করেন।
স্যাম চারিনপুল পুলিশের একজন সহকারী। কিশোররা নিখোঁজ হওয়ার দ্বিতীয় দিনেই তিনি তার মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন। এরপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সাংবাদিক ও উদ্ধারকর্মীদেরকে নিজের মোটরসাইকেল দিয়ে পাহাড়ে ওঠা-নামার কাজ করছেন।
স্থানীয় একজন সরকারি কর্মচারী সরন চুরাত বলেন, ‘আমি সেচ্ছাশ্রম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আটকে পড়া কিশোরদের আমি নিজের ভাই বলে মনে করি। আপনি দেখেন, এখানে সবাই কীভাবে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’
উদন থানি প্রদেশ থেকে এসেছেন রাফায়েল আলুশ ও তার ছেলে শ্লোমি। রাফায়েল ইজরায়েলি নাগরিক ও গুহা ডাইভার। কিশোররা যে গুহাতে আটকে পড়েছে, ২৫ বছর আগেও এ গুহায় ডাইভ দিয়েছিলেন তিনি। যদিও কিশোররা যত ভেতরে আটকা পড়েছে, ততদূর যাননি।
রাফায়েল বলেন, ‘আটকে পড়া কিশোরদের মায়েদের মুখ টিভিতে দেখে আমার বুক ভেঙে গেছে। আমার অবশ্যই তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে।’
রাফায়েল এবং তার ছেলে শ্লোমি এ উদ্ধার অভিযানে অনুবাদক হিসেবে কাজ করছেন।
উদ্ধার অভিযানটি প্রথমে ছিল অনেক বিশৃঙ্খল। স্থানীয় নাগরিক ম্যাক্স ইয়াত্তাপং কুমসামুত দেখছিলেন উদ্ধারকারীরা বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, যেগুলোতে তার অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি দেখছিলেন, উদ্ধারকারীরা গুহা থেকে পানি পাম্প করে বের করতে সমস্যার মুখে পড়ছে।
বিবিসিকে ম্যাক্স বলেন, ‘খনন ও ভূপৃষ্টের নিচের পানি উত্তোলনের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমি তাদেরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেই। ঘটনাটি যখন ঘটেছে, তখন কারোরই কোনো ধারণা ছিল না যে কী করতে হবে।’
ম্যাক্স বলেন, ‘সব কিছু খুব দ্রুত ঘটছিল এবং থাইল্যান্ডে আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। উদ্ধারকারীরা জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছিল। তারা অনেক যন্ত্রপাতিও এনেছিল। এমনকি এ অভিযানে কাজে লাগবে না, এমন অনেক যন্ত্রও এনেছে তারা।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ম্যাক্স পানির পাম্পগুলোকে বসানোর কাজে সাহায্য করেছেন। নিজে গুহার ভেতরে ঢুকে পানির পাইপ ঠিক জায়গায় বসিয়েছেন।
গুহার ভেতরে আটকা পড়া কিশোররা এখন ভালো আছে। পানি পরিবেষ্টিত একটি উঁচু জায়গায় আছে তারা। কীভাবে তাদেরকে নিরাপদে গুহা থেকে বের করে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। বহু সেনা সদস্য গুহাটির ভিন্ন প্রবেশপথের সন্ধানে বাইরে থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজছেন। ডাইভিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে বাইরে বের করে আনার কথাও ভাবা হচ্ছে। কিন্তু শুক্রবারের ওই নেভি সিল সদস্য গুনানের মৃত্যুর পর বোঝা গেছে এটা কতটা দুরূহ।
একজন প্রশিক্ষিত ডাইভারের ডাইভ দিয়ে কিশোরদের কাছে পৌঁছাতে ৯০ মিনিট থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। তারপরও প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় তাদের। সেখানে এসব অল্প বয়সী কিশোরদেরকে এভাবে ডাইভ দিয়ে বের করে আনাটা হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার ওপর কিশোরদের অধিকাংশই সাঁতার জানে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার মাস পর বর্ষা মৌসুম শেষ হবে। তখন গুহা থেকে পানি চলে যাবে এবং কিশোররা হেঁটে বের হতে পারবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত গুহায় তারা নিরাপদে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
২৩ জুন ঘুরতে গিয়ে খুদে ফুটবলার ও তাদের কোচ নিখোঁজ হয়। পরে ৩ জুলাই তাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
সূত্র:মিজানুর রহমান-priyo.com;ডেস্ক।
You must be logged in to post a comment.