পশ্চিমে মেঘনা পূর্বে তিতাস। মাঝে সুবিশাল হাওর। নাম আকাশি হাওর। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে জলরাশি। হাওরের পেট কেটে চলে গেছে সরাইল-নাসিরনগর সড়ক। ধরন্তি গ্রামে এই সড়কটিতে দাঁড়ালে দিন শেষে দেখা যাবে সূর্য লুকাচ্ছে পানির নিচে। যেন আরেক কক্সবাজার।
বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাওর থাকে পানিতে টইটম্বুর। যান্ত্রিক জীবনের সকল ক্লান্তি আর অবসাদকে ধুয়ে ফেলতে পারে আকাশি হাওরের ঢেউ। এমন সৌন্দর্যে সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নে অবস্থিত ধরন্তিকে মিনি কক্সবাজার বলছেন কেউ কেউ। প্রতিদিন শত শত ভ্রমণ পিপাসুদের তৃষা মেটাচ্ছে ধরন্তির এই মিনি কক্সবাজার। ঈদ আর নানা পার্বণে এখানে থাকে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাওরের মাঝ দিয়ে চলা ধরন্তির সড়কের দুপাশেই মানুষের জটলা। তাদের কেউ ব্যস্ত সেলফি তোলায়, কেউবা ব্যস্ত প্রিয়জনদের ছবি তুলে দেওয়ায়। আবার কেউ কেউ গোটা পরিবার নিয়ে সড়কের পাশেই চালাচ্ছেন জম্পেশ আড্ডা। সড়কের ব্লক ধরে অনেকেই নেমে যাচ্ছেন হাওরের পানিতে পা ভেজাতে। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ঘুরছেন। প্রিয়জনদের নিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়েও উল্লাসে মেতে উঠতে দেখা গেল তরুণদের।
এই হাওরে সমুদ্রের বেলাভূমি না থাকলেও সড়কের দুপাশে নেমে পর্যটকরা সেই স্বাদই মেটান। হাওরের দিগন্ত জোড়া থৈ থৈ পানি আর আকাশে মেঘের লুকোচুরি খেলায় বর্ষার বিকেলটা মোহময় করে তুলে। ইঞ্জিন চালিত এবং ডিঙ্গি নৌকায় ঘুরতেও রীতিমতো লাইন লাগে।
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকে এই সড়কেই পাওয়া গেল স্থানীয় সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাকে। নেতাকর্মীদের নিয়ে হাওরের বাতাসে গা জুড়াতে এসেছেন তিনি।
তিনি জানালেন, বর্ষা ছাড়াও গ্রীষ্মে পুরো হাওর জুড়ে সবুজ সামিয়ানা বিছিয়ে দেয় কাঁচা ধান। এর কিছুদিন পরই পাকা ধানের সোনালি আভা এক অপরূপ সৌন্দর্য্য ধারণ করে। এলাকায় আসলে ক্লান্তি দূর করতে এটাই তার প্রিয় স্থান।
তবে পর্যটকরা অভিযোগ করেছেন, বসার ব্যবস্থা, টয়লেট, খাবার ইত্যাদির ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়েন তারা। বৃষ্টিতে তাদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। নৌকার পাশাপাশি স্পিডবোট না থাকায় আক্ষেপ করেছেন তারা। দর্শনীয় এই স্থানটি ঘিরে হাউজ নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
নাসিরনগর থেকে সন্তানসহ ঘুরতে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘নিজ গ্রাম থেকে কাছে হওয়ায় এবং যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকায় সন্তানসহ ঘুরতে আসলাম। বাচ্চাগুলো হাওরের ঢেউ দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছে।’
ঢাকা থেকে ধরন্তি দেখতে এসেছেন রাসেল মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে কোন কৃত্রিমতা নেই। আকাশি হাওরের বিস্তর জলরাশি আর বাতাস যে কারো মনকে ছুঁয়ে যাবে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা কমই আছে। চিন্তা করছি পরের বার পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসবো।’
সেলফি আর আড্ডায় ব্যস্ত শহরের মেড্ডা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা রুবেল মিয়া জানান, এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিকেল কাটানো আমাদের প্রথম পছন্দ। মনটা ভরে যায়। নতুন করে জীবনীশক্তি পাওয়া যায় এখানে আসলে। সেজন্যই মনে হয় ধরন্তিকে মিনি কক্সবাজার বলা হয়ে থাকে। তবে খাবার স্টল ও বসার ব্যবস্থা থাকতে অনেক বেশি ভালো হতো।
এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিফাত জানান, প্রায় প্রতিদিনই মোটর সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এখানে ঘুরতে আসেন। হাওরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সড়ক ধরে মোটর সাইকেল চালানোর মজাই আলাদা। একই সাথে ওড়ার আনন্দও অনুভব করা যায়।
সৌদি আরব প্রবাসী সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রামের সুমন মিয়া বলেন, ‘ফেইসবুকে বন্ধুরা যখন ধরন্তি ঘোরার ছবি পোস্ট করে, তা দেখে মনটা বারবার এখানে আসতে চায়। ফলে এই সময়টায় দেশে আসলে প্রতিদিন বিকেল চলে আসি কক্সবাজারের স্বাদ নিতে।’
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা নাহিদা হাবিব বলেন, ‘প্রশাসনিক কাজে আমি একাধিকবার ধরন্তি গিয়েছি। বিকেল কাটানোর অসাধারণ জায়গা এটা। তবে সড়কের দুপাশের ঝোঁপগুলো বড় হয়ে যাওয়ায় রাতে ডাকাতের আস্তানা হয়। দিনেও নানা সমস্যা তৈরি হয়। ফলে আমরা সড়কের দু’পাশ পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছি। দ্রুতই সেই কাজ সম্পন্ন হবে। তাছাড়া ভ্রমণ পিপাসুদের অন্য সুবিধাগুলোর দিকেও আমাদের নজর রয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এখানে একটি যাত্রী ছাউনি করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (সরাইল- আশুগঞ্জ) আসনের সাংসদ ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রিয় ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ধরন্তি হাওর ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র করার দাবি আমি একাধিকবার সংসদে তুলেছি। তা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও পর্যটন মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি। এখানে পর্যটন কেন্দ্র হলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে আগামী বর্ষার আগে এখানে যাত্রী ছাউনি, টয়লেটসহ পর্যটকদের সুবিধার জন্য বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ আমি নিজে উদ্যোগি হয়ে শেষ করবো।’
যেভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে মাত্র ঘন্টা তিনেকের দূরত্বে ধরন্তি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাসে চেপে আসতে হবে সরাইল বিশ্বরোডে। বিশ্বরোড থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় আপনি চলে যেতে পারেন ধরন্তি মিনি কক্সবাজার। তাছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অথবা আশুগঞ্জ নেমে বাস কিংবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় বিশ্বরোড হয়েও চলে যেতে পারেন।
সূত্র:সমীর চক্রবর্তী risingbd.com ডেস্ক।
You must be logged in to post a comment.