সাম্প্রতিক....

তাসের ঘর

-: সীমা চন্দ্র নম :-

টিনের ফাঁক দিয়ে পানি পড়ছে, পুরো ঘর পানিতে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। একদিকে পড়লে একটা কথা পুরোটা ঘরের জায়গায় জায়গায় পানি পড়ে। মুমুর মা রাশেদা বেগম নেকড়ে দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বেহুশ হওয়ার মত অবস্থা, তবুও কি করার। বাজার থেকে রান্না করার জন্য যে লাকড়ি তার অর্ধেক থাকে চালের নিচে টেস দিতে দিতে। মুমুর মা যেদিকে পানি পড়ে সেখান থেকে শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে ঘরের এককোনায় জড়ো করে রাখে ভাঙা চেয়ারে। “বছরে ছ’মাস কাটে শান্তিতে আর ছ,মাস কাটে বৃষ্টির মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে।” দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোট একটি সংসার রশিদের। রাশেদার স্বামী রশিদ মিয়ার ছোট একটি পানের দোকান আছে। পান বিক্রি করার পাশাপাশি বিড়ি, সিগারেট, লিচু, বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি করে কোনো রকমে তার সংসারখানা চলে। “তাই কখনো চালের উপর যে নতুন টিন লাগাবে সে সাধ্য রশিদের হয়ে ওঠে না।” চারিদিকে ভাঙা বেড়া, উপরে ভাঙা টিন দিয়ে ছোট কুড়েঘর; সেই বেড়াতেও কত জোড়াতালি। অনেক বছরের পুরোনো বাড়ি। ঘরের বেড়াগুলো পোকার আক্রমণে মাঝে মাঝে একটা হালকা ধাক্কা লাগলে বেড়াগুলো খসে পড়ে। শীতের সময় সে বেড়ার ফাঁক দিয়ে শু…শু…. বাতাস আসে। কনকনে শীতে রাশেদার ছেলেমেয়ে দুটো কাঁপতে থাকে। রাশেদা বেগম নিজের ছেলে-মেয়েদের যাতে ঠান্ডা না লাগে ঘরের সব কাপড় দিয়ে তাদের ঢেকে রাখে। কিন্তু গরম কাল ঠান্ডা বাতাসে রাশেদার ছেলে-মেয়েরা শান্তিতে ঘুমাতে পারে। বর্ষার সময় মাটিতে ঘুমানোর কোনো উপায় থাকেনা। বৃষ্টির পানিতে মাটি ভিজে যায় ছোট একটি চৌকিতে নিজের ছেলেমেয়েদের রাখে রাশেদা নিজে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকে। “একটু বেশি বৃষ্টি পড়লে পুরো ঘর মেঘনা নদীর মত হয়ে যায়, হাঁসগুলো সাঁতার কাটে সেই পানিতে চাইলে মানুষ ও স্নান করতে পারবে।” হাটু সমান পানি হয়ে যায় ঘরের মধ্যে। রাশেদা সেই পানি নিষ্কাষন করতে করতে রাত থেকে ভোর হয়। রশিদ মিয়া বাজার থেকে চাল, মাছ, ডাল ও সবজি নিয়ে এনেছে। মুমু এত বড় মাছ দেখে খুশিতে নাচছে, কতদিন ধরে এতবড় মাছ খায়নি। মুমুর ভাই অনিক বলল বাবা আমরা আজ অনেক মজা করে খাব। হা খাবে বাবা তোমার জন্যই এনেছি এতবড় মাছ। ইস! বাবা আমাকে মাছের মাথাটা দিতে হবে।

মুমু অনিকের কথায় প্রতিবাদ করে বলল, মাছের মাথাটা আমি খাব।

অনিক: ‘না আমি খাব’

মুমু: না আমি খাব

অনিক চিৎকার দিয়ে বলল না! না! না! আমি খাব।

মুমু: আমি বড় তাই আমি খাব; তুই ছোট তোর খেতে হবে না।

দুজনের মাথা খাওয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে রাশেদা বেগম ধমক দিয়ে দু’জনকে থামাল। দু’জনকে সমান করে মাছের মাথা দেওয়া হবে। এতক্ষণে মায়ের কথায় দু’ভাই-বোন ঝগড়া থামাল। রাশেদা বেগম মাছগুলো কেটে পুকুর থেকে ধুয়ে আনল। রান্না করার সব আয়োজন করে রান্না ঘরে গেল। স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর বস্তা বিছিয়ে রান্না করতে বসেছে। অনেক কষ্টে ফু দিয়ে দিয়ে আগুন ধরাল ভিজা চুলা, সহজেই ধরতে চাই না। রান্নার সময় হলে একটু সাহায্যে করার জন্য ছেলে-মেয়ে দুটিকে কাছে পাওয়া যায় না, কাজ করার ভয়ে দু’ভাই-বোন দূরে গিয়ে বসে থাকে। খাওয়ার বেলায় দেখা যায় খাওয়া শেষ হলে আবার হাওয়ার সাথে মিলে যায়। রাশেদা স্বামীর সাথে এসব কথা বলে যাচ্ছে, স্বামীর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যেন কয়েক মাস অনিদ্রায় ছিল। গত রাতে বৃষ্টির কারনে ঘুমাতে পারেনি; তাই এখন চোখ বুঝতে না বুঝতে গভীর ঘুম চলে এসেছে। স্বামীর ঘুমের অসুবিধা হবে বলে জানালাটা বন্ধ করে দিল, স্বামীর পাশে গিয়ে পাতলা কাথাটা গায়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ললাটে একটা চুম্বন দিয়ে উঠতে রাশেদার হাতের উপর চাপ পড়ল স্বামীর হাতের, একি তুমি ঘুমাওনি?

না

কেন?

তোমার সোহাগ ছাড়া কি ঘুমাতে পারি।

তাই বুঝি?

হুম।

রাশেদাকে কাছে টেনে বাহুডোরে বেধে আলিঙ্গনে জড়িয়ে পড়ল। পরস্পর স্নেহ, ভালবাসা, চুম্বনে ব্যস্ত হয়ে গেল কতদিনের তৃষ্ণা যেন আজ মেটাল। এভাবে এত কাছে প্রেমের বেষ্টনে যেন কতকাল ধরে ছিল না। প্রেমের পরশে চারিদিকে কোলাহল থেকে নিস্তবতা চলে এল; রাশেদার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল, সে এখনো পঁচিশ বছর বয়সী পরিপূর্ণ যুবতী নারী। সাদা বর্ণ ওষ্ঠে তিলক মাকাল ফলের মত চেহারা গড়ন। ছেড়া শাড়িতে মনে হয় রাতের আধারের রঙিন পরী। ভাতের পোড়া গন্ধ পেয়ে রাশেদা নিজেকে ছাড়িয়ে নিযে রান্না ঘরে ছুটে গেল। কোনো রকমে ভাত রান্না হয়ে গেল, মাছ রান্না করার জন্য চুলায় কড়াই বসিয়ে দিল। রাশেদা দেখতে পেল পুরো আকাশটা আবার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে; হয়তো ভারী বাতাস হতে পারে আকাশটা এমন কালো বর্ণ ধারন করেছে যেন পুরো পৃথিবীটাকে গ্রাস করে খাবে। রাশেদা তারাতারি তরকারি রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। একটু দেরি হলে পুরো রান্না মাটি হয়ে যাবে। টিনের ফাঁক দিয়ে পানি পড়লে চুলা নলকূপে পরিণত হয়ে যায়। চাইলে সেই চুলায় মাছ চাষ করা যাবে দু’মাস আগে নতুন প্লাস্টিক এনে চালের উপর বিছিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেটাও রোদের তাপে ফুটো হয়ে গেছে যেটুকো ছিল সেটা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আরেক বাড়ির চালের উপর পড়েছে। আর এখন সাধ থাকলে ও সাধ্য নেই চাল মেরামত করবে। তরকারি রান্না শেষ হলে স্বামীকে ভাত খেতে ডাক দিল রাশেদা। বাইরে হঠাৎ প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়। রাশেদা ছেলে-মেয়ে দুটির কথা চিন্তা করতে লাগল। বাতাসে ছোট ছোট আমগুলো ঝরে পড়েছে। মুমু ও অনিককে খুঁজতে রাশেদা বের হয়েছে। আজ দুজনকে পেলেই আস্ত রাখবে না। মুমু ও অনিক খুশিতে লাফাচ্ছে। তীব্র বাতাসে মুমুর এলোমেলো চুলগুলো হাওয়া ও সাথে দুলছে।

চল অনিক, আমরা জমিদার বাড়ি যাই সেখানে আমরা অনেক আম পাব।

চল আপু অনিক ও মুমু খুশিতে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে।

এরা দুজন যেন এখনো পাখির ছানা। মুক্ত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে-ওখানে। “এদের মত শিশুদের কখনো বিলাসীতা থাকে না তারা অল্পতে সন্তুষ্ট।” আকাশ থেকে অবিরামহীনভাবে বৃষ্টি ও বজ্রপাত পড়ছে।বাতাছে গাছের শুকনো ডালা-পালাগুলো মাটিতে পড়ে রইল। আপু কতগুলো আম পড়ে আছে, মুমু আমগুলো কুড়িয়ে নিল। ইস! আপু দেখ দেখ পাকা কাঁঠাল! কাঁঠালের একভাগ কাঠবিড়ালীর খাওয়া। আপু কাঁঠালটা আমরা দুজনে খেয়ে ফেলি; কাঁঠালটা মুমু গাছ থেকে ছিড়ে জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ের সিড়িতে বসে দুজনে অনেক আনন্দ ফুর্তিতে খেয়ে নিল। ইস! কি মজা আপু এত মজার কাঁঠাল আগে কখনো খায় নি। খাবে কোথায় থেকে কাঁঠাল কেনার সার্মথ্য তো নেই ওর বাবার। আপু কাঁঠালের বীচিগুলো নিয়ে নে; মা ভেজে দিলে দু’জনে মিলে খেতে পারব।

না রে অনিক, মা বুঝতে পারবে আমরা চুরি করে কাঁঠাল খেয়েছি। মা জানতে পারলে আমরা আবার জমিদার বাড়িতে ঢুকেছি দু’জনকে ধোলাই দেবে। কারণ গত বছর এমন দিনে জমিদার বাড়িতে ঢুকে আম নিয়ে বের হওয়ার সময় জমিদার বাড়ির পাহারাদার দেখে ফেলে; দুই ভাই-বোনকে বেধে নিয়ে যায় জমিদার বাড়িতে পাহারাদার। মুমু ও অনিককে বেধে নিয়ে গেছে শুনতে পেয়ে মুমুর মা-বাবা গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে দু’জনকে ছাড়িয়ে আনে। সেদিন অনিককে মা কিছু না করলেও মুমুকে বেতের আঘাতে পুরো শরীর লাল করে ফেলে। মুমুর মা না খেয়ে থাকতে রাজি কারো কোনো কটুক্তি, উস্কানি শুনতে নারাজ। সেদিন মুমু ও অনিককে বেধে নিয়ে যাওয়ার কথা এলাকায় জানাজানি হলে রাশেদাকে এলাকার লোকজন বিদ্রুপ করতে থাকে চোরের মা বলে। সেই কাটার জ্বালা মেয়ের উপর দিয়ে চালায় রাশেদা। সেই থেকে মুমু ও অনিক আর কখনো জমিদার বাড়িতে ঢোকার দুঃসাহস করেনি। জমিদার বাড়িতে ঢোকার শাস্তি হয় অনেক বড় মাপের, কেউ চোর করে ধরা পড়লে সেই চোরকে পুরো শরীরে মবিল মেখে পুরো রাস্তায় জুতার মালা দিয়ে ঘুরায়। এমন ভাবে বেদাঘাত করে চোরের চিৎকার মুমুদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছায়। বড় ধরনের ক্ষতি করলে সে চোরের জেল-জরিমানা হয়। মুমু ভাবে এটা যদি ওদের বাড়ি হত। জমিদার বাড়ির চারিদিকে ফুল-ফলের বাগান নারিকেল, আম, কাঁঠাল, সুপারি, লেবু, পেয়ারা, আতা, কামরাঙ্গা, জলপাই, ডালিম ইত্যাদি ফলের গাছ; আর ফুলের মধ্যে এমন কোনো ফুল নেই যে জমিদার বাড়িতে পাওয়া যাবে না হাসনাহেনা, বেলি, টগর, রজনীগন্ধা, জবা, শিউলি, টগর ফুল সহ আরো কত রকমের ফুল। হিন্দু পরিবারের অনেকে খুব ভোরে ফুল নিতে আসে। অনেক সময় ফুল নিতে এসে জমিদার বাড়ির পোষা কুকুরের দৌড় খেতে হয়। মুমুর চোখ গেল পুকুরের মাঝখানে তিনটা নারিকেল পড়ে আছে। নারিকেলগুলো নিতে পারলে আজকে পিঠা খাওয়া যেত, বাড়িতে চালের গুড়ো ও চিনি ছিল। কিন্তু নিতে পারলো না। এই পুকুর থেকে মুমু একদিন বড়শি পেতে বড় একটা ৩ কেজি ওজনের শোল মাছ ধরেছিল ৫-৬ দিন আগে। সেটা মা রান্না করেছিল সব ধরনের মসলা দিয়ে মাংসের মত হয়েছিল সেদিনের রান্নাটা। মাঝে মাঝে বিষাক্ত সাপ ও দেখা যায় জঙ্গলের ওপার থেকে এপারে আসতে।

চল আপু চলে যায়, দেরি হলে মা আবার খুঁজতে বের হবে।

দাঁড়া, অনিক কয়েকটা বেলিফুল নিয়। চারিদিকে ফুলের সুগন্ধে পুরো বাগানটা যেন মনে হয় স্বর্গরাজ্য। মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি আসছে। আপু সন্ধ্যা হয়ে গেল বুঝি? চল আমার ভয় লাগছে। হঠাৎ করে অনিকের মাথায় একটা পাকা আম পড়ল, অনিক চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুমু হেসে উঠল, মুমুর হাসি দেখে অনিক আরো বেশি কান্না করছে অভিমানে। দেখি ভাই, কোথায় পড়ছে? অনিক মুমুর হাতটা ছাড়িয়ে নিল। অনিককে মুমু অনেক ভালবাসে। বোন পাশে থাকলে অনিকের সাহস বেড়ে যায়; অনিককে কেউ মেরেছে শুনতে পেলে মুমু গিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আসে। তাই অনিককে খেলার সঙ্গীরা গায়ে হাত তুলতে ভয় পায়। অনিককে মুমু অনেক স্নেহ করাতে কোনো কিছু হলে মুমুর ওপর অভিমান করে বসে থাকে। দাঁড়া অনিক আমটাকে এখন শায়েস্তা করব, আমটা নিয়ে মুমু একটা ইট দিয়ে থেথলিয়ে ফেলে, অনিক হাসতে থাকে। এতক্ষনে অনিকের রাগ কমল; ভাইয়ের চোখের জল মুছে দু’ভাই-বোন আলিঙ্গন করল। ভাই-বোনের ভালাবাসার কাছে সকল ভালবাসা পরাজিত হয়। দরজা খুলে দারোয়ান বের হল মুমু ও অনিক এক নিঃশ্বাসে জমিদার বাড়ি অদূরে গিয়ে দাঁড়াল। মুমু ও অনিক অট্টাহাসি দিতে লাগল। আপু কি বাঁচা না বাঁচলাম আজকে; ধরা খেলে আমরা দুজনকে জেলে দিত। মুমু হাসির জন্য কথা বলতে পারল না, আপু অনেগুলো আম তো পরে গেল। দারোয়ানটা নতুন এসেছে তাই অনিক মুমুকে চিনতে পারবে না। বাড়িতে গিয়ে দেখে মা কান্না করছে। মুমু ও অনিককে দেখে রাশেদা কান্না আরো বাড়িয়ে দিল।, দু’জনকে জড়িয়ে ধরল বুকে রাশেদা। মুমু মনে মনে ভাবল যাক বাঁচা গেল।

কোথায় গিয়েছিলি তোরা দুজন? মায়ের মুখে ধমকের সুর, তোরা দু’জনকে পুরো এলাকা তন্ন তন্ন খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ মায়ের ধমক খেয়ে দু’জন ভয় পেয়ে গেল। অনিক তাকিয়ে আছে মুমুর দিকে মুমু তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। দু’জনের মুখে কাঁঠালের আঠা লেগে আছে। মুমুর মা বুঝতে পারে ওরা জমিদার বাড়িতেই গিয়েছে, জমিদার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও এখানে কাঁঠালের গাছ নেই……………..।

তোরা আবার জমিদার বাড়িতে গিয়েছিস? মুমু ও অনিক ধরা খেয়ে মাথা নিচু করে আছে। রাশেদা বেগম দুই ছেলে মেয়েকে আর শাসাতে পারে নি রশিদ মিয়া থাকাতে। রশিদ মিয়ার আদরের টুকরো ওরা। দু’জনের ভিজা কাপড় খুলে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিল। দু’জনকে মাছের মাথা দু’ভাগ কর দিল।অনেক দিন পর দু’জনে বড় মাছের মাথা দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে নিল। অনিক মুমুকে চুপি চুপি বলল আপু জমিদার বাড়ির দারোয়ান তো আমাদের দেখেছে যদি আসে? আমাদেও যদি আবার আগের মত বেধে নিয়ে যায়। আসবে না আমাদের বাড়ি তো চেনে না আসলে অনেক আগে আসত। আর যদি আসে আম দিয়ে দারোয়ানের মাথাটা ফাটিয়ে দিব। বোনের এমন সাহসিকতা দেখে অনিক আরো জোড় দিয়ে বলল আমি লাঠি দিয়ে পিটা দেব। দুজনের মধ্য এমন সাহসের সঞ্চার হওয়াতে দু’জনে আনন্দে হেসে উঠল। এমন সময় ভয়ঙ্কর তুফান শুরু হয়ে গেল বাসাসে পুরো ঘর দুলছে। বাতাসে প্রদিপটা নিভে গেল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না। রাশেদা বেগম চিন্তায় পড়ে গেল এমন ভর সন্ধ্যায় কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। রশিদ মিয়ার ক্ষণিক আগে দোকানে চলে গেছে। রান্নাঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে পানিতে চুলাটা থই থই  হয়ে গেল চুলাটা পানিতে ডুবে গেল ইঠানের সামনে মেহগনি গাছটা হেলে পড়ল। দুর থেকে ডালা-পালা উড় এস টিনের উপর পড়ছে।

রাশেদা বেগম স্বামীর জন্য উদিগ্ন হয়ে রইল। কবে যে বের হল এখনো আসার নাম নেই। না, মনটা কেন হঠাৎ ছটফট করছে। মনের মধ্য একটা অচেনা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল, কি এমন সম্পদ যেন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যেটা ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সার চেয়ে মূল্যবান। দুই ছেলে-মেয়েকে বুকে নিয়ে চৌকির নিচে মাথা গুজে আছে রাশেদা। বাড়ির সব খুটি পোকা ধরেছে; কখন যে গায়ের উপর পুরো বাড়িটা পড়ে নিশ্চয়তা নেই। টিনের উপর বড় বড় গাছের ডালা-পালা পড়ার বিকট শব্দ। মুমু ও অনিক তীব্র ঠান্ডায় কাঁপছে, টিনের চাল পুরোটা উড়িয়ে নিয়ে গেল রান্না ঘরের বেড়াটাও ভেঙে মাটিতে লুটে আছে। এ যেন খন্ড প্রলয় শুরু হল ছেলে-মেয়েদের কাঁপনী দেখে রাশেদার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে সেই জল বৃষ্টির পানিতে মিশে গেল। হঠাৎ বজ্রপাতের বিকট শব্দে অনিক চিৎকার করে উঠল, অনিক মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাশেদা এই ঝড়-ঝাপটার মধ্যে কখন দু-চোখ বুজে এল বুঝতে পারে নি। কেমন একটা দুঃস্বপ্নে রাশের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এ কি স্বপ্ন দেখল রাশেদা জীবনের বাকি সময় কাকে নিয়ে কাটাবে রাশেদা। ভোর হওয়াতে রাশেদা ঘর থেকে বের হল। উঠোনে পড়ে আছে দুটি মৃত বাবুই পাখির ছানা, বাড়ির চারিপাশে পড়ে আছে গাছের ডালাপালা। “রাশেদা দেখতে পেল কিছু লোক ধরাধরি করে কাকে যেন সামনের দিকে আসছে, রাশেদা দৌড়ে গেল সেদিকে।” এ কার নিথর দেহ দেখছে রাশেদা, রাতে যে স্বপ্ন দেখছে সে স্বপ্নটা বাস্তবে তার সামনে হাজির হল। রাশেদার হৃদয়খানা দুমড়ে-মুছড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হেত লাগল। রাতে অনিক যে বজ্রপাতে চিৎকার করে উঠে সেই বজ্রপাতে মারা যায় রশিদ মিয়া। দোকান বন্ধ করে মাছ ধরতে গিয়ে রশিদের অবস্থা। মুমু ও অনিকের কান্নায় আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনি হতে লাগল। এ কেমন নিয়তি, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বুকের উপর যেন পাহাড় সমান পাথর বসিয়ে দিল; রাশেদার জীবনে “কুল কাঠের আগুনে জ¦লতে লাগল রাশেদা। আপু বাবা ঘুম থেকে উঠছে না কেন? মাটিতে শুয়ে আছে কেন? বাবা কি রাতে ঘুমাইনি? অনিকের হাজার প্রশ্নের জবাব, কি উত্তর দেবে রাশেদা। বাবা… অ…বাবা… মায়ের সাথে বুঝি রাগ করে উঠোনে শুয়ে আছ বাবা… অ…বাবা….। মা বাবা কথা বলছে না কেন? ‘মুমু বুঝতে পেরেছে ওদের বাবা এই পৃথিবী থেকে অভিমানে বিদায় নিয়েছে, মুমুর অঝোরে কান্না করছে। রাশেদার আর কেউ রইল না পৃথিবীতে। যার হাত ধরে রাশেদা একদিন এই অজপাড়া গায়ে পালিয়ে এসেছিল। জমিদার বংশের রূপবতী কন্যা ছিল রাশেদা। রশিদ মিয়া ওদের বাড়িতে কাজ করত। রশিদের সততায় মুগ্ধ হয়ে রাশেদার মা-বাবা নিজের ছেলের মত করে দেখত রশিদকে। এক পর্যায়ে রাশেদা রশিদের প্রেমে পড়ে যায়। রশিদকে রাশেদা সে কথা বললে রশিদ রাশেদাকে এড়িয়ে চলে অনেকদিন। কারন রাশেদা ও রশিদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। রশিদ ওদের বাড়িতে কাজ করে যে টাকা পায় সে টাকা দিয়ে রশিদ ওর মা-বাবার ভরণ-পোষনে ব্যয় হয়। জমিদার বাড়ি ছাড়া রশিদ আর কোথায় ভালো বেতনে কাজ পায় না। রাশেদার মা-বাবা জানলে হয়তো এই এলাকা ছাড়া করবে যার কষ্ট পোহাতে হবে রশিদের মা-বাবার। রশিদ মা-বাবার একমাত্র ছেলে। রশিদ যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে রাশেদা তত কাছে এসে ভিড়ছে রশিদের। রশিদ যখন বুঝতে পারে রাশেদা অনেক ভালবাসে রশিদকে রশিদও দূর্বল হয়ে পড়ে রাশেদার প্রতি। সেকথা জানতে পেরে রশিদকে বেদড় মারধর করে চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়। তার পরদিন রাশেদা রশিদকে নিয়ে পালিয়ে আসে জমিদারিত্ব, বংশমর্যাদা ধন-ধৌলত ছেড়ে। আর কখনো মা-বাবার কাছে ফিরে যায়নি রাশেদা। রাশেদা হঠাৎ চিৎকার করে বলছে হে আল্লাহ! এই কেমন তোমার নিষ্ঠুরতা! তোমার কাছে কখনো ধন-ধৌলতের জন্য ভিক্ষা চাইনি সর্বদা তোমার কাছে আমার স্বামীর মঙ্গল কামনা করেছি, সারাজীবন তোমার ইবাদত করেছি এই কেমন বিচার তোমার। রাশেদার কান্না দেখে মুমু ও অনিক ফুফিয়ে ফুফিয়ে কান্না করছে। রাশেদার জীবনে বিশাল ভাটা পড়ল। তুষের আগুনের মত জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে রাশেদার হৃদয়টা। দুই ছেলে-মেয়ে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে করে কাঁদছে………………………………………..।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়োজনে কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার জন্মদিনে হুদা মেলা…….

এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও :দরিয়া নগরের জাতিসত্ত্বার কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার জন্মদিন উপলক্ষে একদিন ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/