সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / সাম্প্রতিক... / সাংস্কৃতিক ও বিনোদন / গণমানুষের কবি সিকান্দার আবু জাফর

গণমানুষের কবি সিকান্দার আবু জাফর

sikander-abu-zafor

তিনি সংগ্রামে জাগরণে বারবার ফিরে আসেন অনুপ্রেরণার অভিভাবক হয়ে। কবি সিকান্দার আবু জাফর বাঙালীর সেই অনুপ্রেরণার দায়িত্বশীল কবি ও সাংবাদিক। যিনি বাংলার সব থেকে বড় জাগরণের সংগ্রাম মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে জাগিয়েছে অন্য ধারায়। তারা লেখনি বারবার শোষন মেনে নেয়া জাতিকে দেখিয়েছে মুক্তির সংগ্রামের বিপ্লবী দিশা। তিনি নিজেকে সরাসরি বামপন্থী পরিচয় দিয়েছেন এমন পাওয়া যায়নি সচারচার। কিন্তু তার লেখার যে বিশেষত্ব তা বামপন্থার শ্রেণী সংগ্রামের সংস্কৃতিকেও স্পর্ষ করে। আমাদের দেশে তার পরবর্তি কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখায় এমনও নির্দেশনা পাওয়া যায়। তার সমসাময়িক কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতায় ও এ ধারা আছে। তবে যেসব কবির লেখা আমাদের অনেক বেশী আন্দোলিত করে তাদের মধ্যে সিকানদার আবু জাফর অন্যতম। যিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন।

সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সর্বোপরি সাংবাদিক। সাহিত্যিক হিসেবে সিকানদার আবু জাফর যতোটা প্রসিদ্ধ ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন একজন পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সিকানদার আবু জাফর বিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন। আমরা যে মুক্তচিন্তার স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি তারমূলে ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর এবং তাঁর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকার নানা উদ্দীপনামূলক নিবন্ধ। সিকানদার আবু জাফর ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কী যে অদ্ভুত মিল বাঙালীর জাতীয় নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে তার রয়েছে অদ্ভুত এক মিল। তাদের দুজনের রয়েছে সংগ্রামী বর্ণিল জীবন। দু’জন মফস্বল থেকে উঠে শুধু নগর নয় জাতির পথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাদের দুজনের জন্ম মৃত্যু মাসও একই। কবির পিতা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেমী ছিলেন একজন কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী। স্থানীয় বিডি ইংরেজি স্কুল হতে প্রবেশিকা পাস করে কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন এবং কিছুকাল এ কলেজে অধ্যয়ন করেন। সিকানদার আবু জাফর ছাত্রজীবনেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং সেইসঙ্গে সাংবাদিকতার প্রতি আকৃষ্ট হন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত কলকাতার ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্যদিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকে রেডিও পাকিস্তানের শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৮-৫৩ পর্যন্ত তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানে স্টাফ আর্টিস্ট ছিলেন। এরপর ১৯৫৩ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’র সহযোগী সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে ‘দৈনিক মিল্লাতে’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে আজীবন দেশের প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র সমকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকালে’র প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর সমকাল পত্রিকা ব্যবহার করতেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ত্রিশোত্তর ধারার প্রগতিশীল মুক্ত সাহিত্য ধারার বিকাশ, আন্দোলন এবং নতুন লেখক সৃষ্টিতে প্রেরণা দান করেন।

শুধু সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, সাহিত্য পত্রিকা মাসিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও সিকানদার আবু জাফরের অবদান স্মরণীয়। একজন বিপ্লবকামী কবি হিসেবে অসংখ্য গণসঙ্গীত লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের পরে সিকান্দার আবু জাফর ছিলেন নজরুল চরিত্রের দ্বিতীয় একজন। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় তাঁর রচিত গান বাঙালির মুক্তির সংগ্রামেই প্রেরণা যুগিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এবং সাহসী সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর সময় দ্বারা আন্দোলিত হয়েছিলেন এবং তাঁর লেখার মাধ্যমে জনসাধারণকে উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নত ধারায় যেসব গুণীসাহিত্যিকের কথা স্মরণে আসে তাদের মধ্যে সিকানদার আবু জাফর অন্যতম। তিনি আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের ভিত রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তত্কালীন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি চর্চার যে ধারা প্রবাহিত হয় সিকানদার আবু জাফর ছিলেন তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। একজন সংগ্রামী কবি হিসেবে অসংখ্য গণসঙ্গীত লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত গান ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। আদ্যোপান্ত বাঙালি সিকানদার আবু জাফর ছিলেন স্বাধীনতার জন্যে উদগ্রীব একজন মানুষ। তার কবিতায় যুগ যন্ত্রণা বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য সাহসের অধিকারী একজন মানুষ যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত ‘বাঙলা ছাড়ো’ কবিতায়। ‘বাঙলা ছাড়ো’ কবি সিকান্দার আবু জাফরের একটি অসাধারণ কাব্য গাথা। রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলো/আজকে যখন হাতের মুঠোয় কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি/কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে কেউটে সাপের ঝাপি/আমার হাতেই নিলাম আমার নির্ভরতার চাবি/ তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া/ তুমি বাংলা ছাড়ো। (সংক্ষেপিত)

সিকান্দার আবু জাফরের রচিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা, শকুন্ত উপাখ্যান, মহাকবি আলাওল ইত্যাদি। উল্লেখ্য ১৯৬৬ সালে তিনি নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচিত উপন্যাস, মাটি আর অশ্রু, পূরবী, নতুন সকাল ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থ : মতি আর অশ্রু। কিশোর উপন্যাস : জয়ের পথে, নবী কাহিনী ইত্যাদি।

অনুবাদ : রুবাইয়াত্ ওমর খৈয়াম, সেন্ট লুইয়ের সেতু, বারনাড মালামুডের জাদুর কলস, সিংয়ের নাটক ইত্যাদি এবং গানের মধ্যে মালব কৌশিক উল্লেখযোগ্য। কবি হিসেবে অসংখ্য গণসঙ্গীত লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তার রচিত গান। ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই॥’ মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে।

কবি ও খ্যাতিমান এ সাংবাদিককে আমরা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। কবি গণমানুষের মাঝে পৌছেছেন। নিজের শক্তিধর লেখনী ধারায়। কবিকে সাধারণ মানুষ চিনেছে তাদের প্রাণের বার্তা তার কলম থেকে চলে আসার কারণেই। দুঃখজনক হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি কবি’র থেকে আর শেষের দিকের মানসম্পন্ন মানুষের জন্য সাতক্ষীরায় অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু সাতক্ষীরার মাটিতে সাতক্ষীরার এ কৃতিসন্তানের জন্য আমরা দিতে পেরেছি এমন গুরুত্ববহ কিছু নেই। আমাদের প্রাণের চাওয়া দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাপীঠ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ কবি সিকান্দার আবু জাফরের নামে নামকরণ করা হোক। ভারত উপমহাদেশে অনেক কবি সাহিত্যিক তথা এধরণের মহামানবদের জন্যে অনেক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। আমাদের প্রাণের চাওয়া সাতক্ষীরা সরকারি কলেজকে তার নামেই প্রতিষ্ঠা করেই তাকে জেলার ছাত্রসমাজের কাছে পৌছে দেয়া হোক সহজে। যাতে এমন মানুষের লেখা ও জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ মাটি ও মানুষের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে সবসময়। যেভাবে তরুণ সমাজ ঝাপিয়ে পড়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবেই কবিতা দিয়ে।

জনতার সংগ্রাম চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাস্যের নির্মোক ছাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

প্রতারণা প্রলোভন প্রলেপে

হ’ক না আঁধার নিশ্ছিদ্র

আমরা তো সময়ের সারথী

নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।

দিয়েছি তো শান্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি তো সম্ভ্রম আরও দেবো অস্থি

প্রয়োজন হ’লে দেবো একনদী রক্ত।

হ’ক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,

অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে

একদিন সে-পাহাড় টলবেই।

চলবেই চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

মৃত্যুর ভর্ত্সনা আমরা তো অহরহ শুনছি

আঁধার গোরের ক্ষেতে তবু তো’ ভোরের বীজ বুনছি।

আমাদের বিক্ষত চিত্তে

জীবনে জীবনে অস্তিত্বে

কালনাগ-ফণা উতিক্ষপ্ত

বারবার হলাহল মাখছি,

তবু তো ক্লান্তিহীন যত্নে

প্রাণে পিপাসাটুকু স্বপ্নে

প্রতিটি দণ্ডে মেলে রাখছি।

আমাদের কি বা আছে

কি হবে যে অপচয়,

যার সর্বস্বের পণ

কিসে তার পরাজয়?

বন্ধুর পথে পথে দিনান্ত যাত্রী

ভূতের বাঘের ভয়

সে তো আমাদের নয়।

হতে পারি পথশ্রমে আরও বিধ্বস্ত

ধিকৃত নয় তবু চিত্ত

আমরা তো সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী

চলবার আবেগেই তৃপ্ত।

আমাদের পথরেখা দুস্তর দুর্গম

সাথে তবু অগণিত সঙ্গী

বেদনার কোটি কোটি অংশী

আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি

সকল বিরোধ-বিধ্বংসী।

এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল

কোনোদিন আমরা যে ভাঙবোই

মুক্ত প্রাণের সাড়া জানবোই,

আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে

নূতন সূর্যশিখা জ্বলবেই।

চলবেই চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

সূত্র: মিডিয়াখবরডটকম,ডেস্ক।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

https://coxview.com/wp-content/uploads/2023/10/Entertainment-Mozib.jpg

মুক্তির অপেক্ষায় ‘মুজিব’

  অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/