সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / প্রাকৃতিক ও পরিবেশ / নাব্যতা সংকটে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী : নদীর বুঁকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর

নাব্যতা সংকটে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী : নদীর বুঁকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর

প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা হারানো দৃশ্য।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; লামা :
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্তের পাহাড়ভাঙ্গা নামক স্থান থেকে প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর সৃষ্টি। বাংলাদেশে মাতামুহুরী একমাত্র নদী যা এদেশে সৃষ্টি এদেশেই সমাপ্ত হয়েছে। চিরচেনা এই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠা জনবসতির বর্তমান রূপই হচ্ছে বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলা। অপরূপ মাতামুহুরীর শীতল স্নিগ্ধ জলরাশি সূত্র ধরে আবিষ্কার হয় এই দুইটি উপজেলার। এককালের প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী এখন মরা নদীতে রূপ নিচ্ছে। পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাথর আহরণের কারণে নাব্যতা সংকটে পড়েছে এই স্রোতশীল নদীটি। এখন বর্ষা শেষ না হতেই নদীর বুকে জেগে উঠছে অংখ্য চর। যা ফলে নৌ চলাচল, মৎস্য সম্পদ সংকট, কাঠ ও বাঁশ পরিবহনে দুর্ভোগের অন্ত থাকছে না।

মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল মাতামুহুরী রিজার্ভের পাহাড়ভাঙ্গা এলাকা।

আলীকদম উপজেলার দুর্গম মাতামুহুরী রিজার্ভ হতে উৎপত্তি হয়ে লামা ও চকরিয়া উপজেলা উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীটি সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
মাতামুহুরী নদী বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চল বান্দরবন ও কক্সবাজার জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৪৬ কিলোমিটার (৯১ মাইল), গড় প্রস্থ ১৫৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বঙ্গোপসাগরে মাতামুহুরীর মোহনায় যে বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে তা ভোলাখাল থেকে খুটাখালি পর্যন্ত বিস্তৃত। চট্টগ্রাম থেকে আরাকানকে বিভক্তকারী পর্বতমালায় ২১.১৪ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ ও ৯২.৩৬ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ উদ্ভূত একটি নদী। এর উৎসস্থান সাংগু নদীর উৎস থেকে মাত্র ১ ডিগ্রি উত্তর ও ১ ডিগ্রি পূর্বে অবস্থিত।

লামা উপজেলা অন্যতম লেখক ও গবেষক সাংবাদিক এম. রুহুল আমিন বলেন, ইংরেজী বর্ণ ‘ওয়াই’ অক্ষরের মতো আকার নিয়ে মাতামুহুরী নদীর জন্ম হয়েছে। এ নদীকেই ঘিরেই লামা-আলীকদম উপজেলায় জনবসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়া গত দুই দশকে এই অঞ্চলে বিষবৃক্ষ তামাক চাষের কারণে প্রভাব পড়েছে এই নদীর উপরে। নদীর দু’পাড়ে তামাক চাষ ও তামাকের ব্যাপক জ্বালানী সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড় গুলো বৃক্ষ শূণ্য হয়ে পড়েছে। যার দরুন একদিকে যেমনি নদীর দুই পাড় ভেঙে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে তেমনি পাহাড় গুলোতে বৃক্ষশূণ্য হয়ে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে।

লামা উপজেলা প্রবীণ ব্যাক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা শেখ মাহাবুবুর রহমান বলেন, গেল আশির দশকে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৫০-৬০ ফুট। প্রস্থ ছিল ৩শত থেকে ৪শত ফুট পর্যন্ত। নদীতে ছিল বড় বড় কুম (বিশাল নীল জলরাশি)। বর্তমানে তলা ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা আছে ১৫-২০ ফুট পর্যন্ত। গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দু’কুল ভেঙ্গে প্রস্থ বেড়ে ১৫শত থেকে ১৬শত ফুট পর্যন্ত হয়েছে। অথচ এককালে গভীর জলরাশি সম্পন্ন প্রমত্তা মাতামুহুরী কালের বিবর্তনে এখন শীর্ণকায় নদীতে রূপ নিয়েছে। একইসাথে লামা উপজেলার আরো ৮টি খাল ও অসংখ্য ঝিরি ভরাট হয়ে নাব্যতা সংকটে পড়েছে।

প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা হারানো দৃশ্য।

সরকারী পরিসংখ্যান মতে, মাতামুহুরী নদীর আয়তন প্রায় ১৮৮০ একর। নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই এলাকার মৎস্য ভান্ডারেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব এবং দারিদ্রতার চরম হতাশা নেমে এসেছে জেলে পাড়াতে।

লামা, আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার অসংখ্য ঝিরি ও খাল প্রকৃতির বুক চিরে মিশেছে মাতামুহুরী নদীতে। এ নদীর ভূমি ঢাল পশ্চিমমুখী। উৎপত্তিস্থলে থেকে সর্পিল গতিতে একেবেঁকে মাতামুহুরী নদী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

লামা বাজারের শতবর্ষী ব্যাক্তিত্ব উচিহ্লা মার্মা জানান, মাতামুহুরী নদীর নামানুসারে গড়ে উঠেছে ১ লক্ষ প্রায় ২০ হাজার একরের বিশাল রিজার্ভ ফরেস্ট। এ রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে গত দেড় দশক ধরে অবাধে বৃক্ষ নিধন, বাঁশ কর্তন ও পাহাড়িয়া জুম চাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে পড়ছে নদীতে। ফলে নদীর তলদেশ ক্রমশঃ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় ও ঝিরি খুঁড়ে অবাধে পাথর উত্তোলনের কারণে ঝিরি থেকে পানির প্রবাহ কমে গেছে। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

এদিকে মাতামুহুরী নদী নাব্যতা সংকটের কারণে প্রতি বছর গড়ে ৪/৫ বার ভয়াবহ বন্যায় লামা, আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার বিস্তৃীর্ণ অঞ্চল ও জনবসতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই নদীর বুকে বুকে জেগে উঠবে অসংখ্য চর। নদীর নাব্যতা হ্রাসের ফলে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠা জনবসতির চরম কষ্ট দেখা দিয়েছে।

নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্বের সময়কার দিনে মাতামুহুরী নদীর উপরের দিকে পাহাড়ি এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ভরপুর থাকায় সেই সময়ে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির সাথে বালু মাঠি কম আসতো। এখন বনদস্যুদের ভয়াল গ্রাসের কারণে অধিকাংশ গাছপালা উজাড় হয়ে গেছে। বন উজাড় ও পাহাড় কাটা এবং পাথর আহরণের ফলে পাহাড়ি ঢলের বালি ও মাটি নদীর বুকে এসে পড়ছে। ফলে ক্রমশঃ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বর্তমানের অবস্থায় পরিণত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে পাহাড়ি ঢলের পানি নদীর বিপদ সীমার উপর প্রবাহিত হয়ে অসংখ্য ঘরবাড়ী ভেঙ্গে গিয়ে অনেক প্রানহানির ঘটনা ঘটে। তাই মাতামুহুরী নদীর অভ্যন্তরে গভীরতা বৃদ্ধি করা অতীব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধারে ড্রেজিং করা লামা উপজেলা সকল মানুষের প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

কালের সাক্ষী ২০০ বছরের পুরনো তেলশুর গাছ ! https://coxview.com/tree-200-years-rafiq-5-2-24-1/

কালের সাক্ষী ২০০ বছরের পুরনো তেলশুর গাছ !

লামা বন বিভাগের বমু রিজার্ভ ফরেস্টের পুকুরিয়াখোলা এলাকায় অবস্থিত বৃহৎ তেলশুর গাছ দুইটি।   মোহাম্মদ ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/