মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; লামা :
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে এককাপ গরম চা কিংবা কফি শরীর ও মনকে নিমিষেই চাঙা-সতেজ করে তোলে। দেশে চায়ের পাশাপাশি কফির প্রতি মানুষের দুর্বলতা অনেক বেড়েছে। সে কারণে দেশেও কফির জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি পাহাড়ে এখন ব্যাপকভাবে কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, এদেশে চা চাষের ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও কফি চাষ খুব বশি দিনের নয়। গত কয়েক বছর পাহাড়ে স্বল্প পরিসরে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। চা চাষের সফলতার পর এবার কফি চাষের ভালো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। দেশের তিন পার্বত্য জেলাগুলোয় বেশকিছু জায়গায় কফি বাগান গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোমী ও আগ্রহী কৃষকের হাত ধরে পাহাড়ে কফি চা চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রথমে সখ করে দু একজন কফি চারা রোপন করলেও এখন অনেকে বাণিজ্যিকভাবে রোপন করেছে কফি চারা।
এদেরই একজন পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ব্রীকফিল্ড এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (প্রাথমিক) প্রমোদ চদ্র বড়ুয়া। তার বাগান ঘুরে দেখা যায় তার সৃজিত ফলজ বাগানের ভিতরে ২ একর জায়গায় ১২২৫টি কফি চারা লাগিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে লামায় প্রত্যেক ইউনিয়নে পাহাড় কিংবা পাহাড়ের ঢালু গড়ে উঠেছে কফি চাষ। এ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিমালিকানায় প্রায় ৬৫ একর জায়গাজুড়ে ২৯৭৭৫টি কফি গাছ লাগানো হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ২০১৮-২১সাল পর্যন্ত ৭ জন কৃষক, বাণিজ্যিকভাবে ২০২১ সাল ৬৬ জন কৃষক কফি চাষ করে। হর্টিকালচার ও ডিএই এর মাধ্যমে ৬৬ জন কৃষককে চারা, সার, নেট ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২.৫ একর করে ৫টি বাণিজ্যিক ও ৫০ শতক করে ৫০টি কফিজাত প্রযুক্তি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ছেন কৃষি অফিস।
এদিকে দু একটি কফি বাগান ঘুরে দেখা যায় কোথাও সারিবদ্ধভাবে, কোথাও গাছের ফাঁকে ফাঁকে এবং কোথাও পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢালুতে কফি চারা লাগানো হয়েছে। কোথাও গাছে ৩ থেকে ৪ফুট লম্বা আবার কোথাও বয়স এক সপ্তাহ হতে এক মাস হয়েছে। কোন কোন গাছে ফল আসতেও দেখা যায়। তবে তা পরিপক্ব হয়নি এখনও। ঝাঁকড়ানো সবুজ পাতা আর ফলন ইঙ্গিত করছে প্রত্যান্ত অঞ্চলে একদিন অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাবনার নব দিগন্ত হবে কফি চাষ।
একই ইউনিয়নের আখিরাম পাড়ায় আরেকটি বাগান ঘুরে দেখা যায় ৪ থেকে ৫ ফুট লম্বা হয়েছে কফি গাছ। কয়েকটি গাছে ফলও এসেছে। নতুন উদ্যোক্তা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাথায়াইচিং মার্মা জানান, প্রথম তিনি আম বাগান সৃজন করলে তা দেখে অনেকে আম বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তেমনি কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে কফি চাষ কৃষকদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে ৪ হাজার কফি চারা লাগান তিনি।
এ্যাসাসিয়েশন অব ড্যাবটিস্টর কফি এক্সপোর্ট প্রশিক্ষক তদরাম ত্রিপুরা বলেন, একটি কফি চারার মূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এই গাছ ৭০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচে ও ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। এরপর ডালপালা ছেটে মোর্তগাছের একফুট উপর থেকে তির্ডকভাব কেটে দিলে পুণরায় ফলন পাওয়া যায়। ১টি গাছ প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ কেজি ফলন দেয়। এর বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। কফি চাষীদের জন্য সুখবর হচ্ছে দেশীয় ও বিশ্ববাজার কফির মূল্য একই থাকে। ফল এর কোন সিন্ডিকেট থাকেনা। দেশে একমাত্র কফি বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নর্দান এন্ড কফি রাষ্টার কোম্পানী।
উপজেলায় প্রথম উদ্যোক্তা তদুরাম প্রথমে ৩ একর জায়গায় সাড়ে তিন হাজার পরে ১২ হাজার কফি চারা লাগান তিনি। তার চারার বয়স ৪ বছর হয়েছে। ৩ বছরের মাথায় কিছু কিছু গাছে ফলন আসে। আবাদি অনাবাদি দুটাতেই কফি চাষ করা যায়। কফি ছায়া সহনীয় গাছ বিধায় চাষীদের জন্য সুবিধা হচ্ছে কফি বাগানের ভিতরে অন্যান্য বাগান কিংবা অন্যান্য বাগানের ভিতরে কফি বাগান করা যায়। ফল অন্যান্য চাষের চেয়ে কফি চাষ কৃষকের লাভের সম্ভাবনা বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন চদ্র বর্মন বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধিনে কাজু বাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহন করায় দেশে কফি চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কফি চাষের দুই তৃতীয়াংশ চাষ হয় পার্বত্য অঞ্চলে। বান্দরবান জেলাসহ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যান্য জেলায় আগে থেকে কফি চাষ থাকলেও এতো বেশি সাড়া মিলেনি। অধিদপ্তরের উদ্যোগের কারণে প্রকল্পের আওতায় কফিচাষ দিনদিন আগ্রহী হয়ে উঠেছে কৃষকরা। প্রকল্পের আওতায় দুই অর্থ বছরে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ১১৫৬৫টি চারাসহ সার, নেট, নগদ অর্থ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে কৃষকদের মাঝে।
You must be logged in to post a comment.