মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; লামা:
‘আমি শিক্ষকতায় দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের ও দেশের জন্য সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছি, কিন্তু এ সম্মানই এখন আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এখন অসহায়-নির্যাতিত। আমাকে বাঁচতে দিন’। এমন আকুতি জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক সেরা শিক্ষক এ্যাওয়ার্ড ও ২০১৫ সালে সরকার ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় ‘গ্লোবাল লার্নিং’ এর ওপর তিনি লন্ডন থেকে এ্যাওয়ার্ড পাওয়া বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চম্পট পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিসেস জয়নব আরা বেগম।
জানা গেছে, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৩ সালে সরকারি চাকুরীতে যোগ দেন শিক্ষক জয়নব আরা বেগম। যোগদানের পর আলীকদম উপজেলার মাংতাই হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত বছর চাকুরী করে ২০১০ সালে ২৫ এপ্রিল আলীকদম চম্পট পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলী হন। এরপর তিলে তিলে নিজের মেধা ও পরিশ্রমে চারবার জেলার “শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” নির্বাচিত হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এটুআই পরিচালিত ‘শিক্ষক বাতায়নে’ ২০১৩ সাল থেকে ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাণ করে দেশের ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন তিনি।
www.teachers.gov.bd (শিক্ষক বাতায়ন)-এ বর্তমানে দেশের সেরা নয়জন শিক্ষকের মাঝে জয়নবের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক ‘সেরা শিক্ষক; এ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় এ গুণি শিক্ষককে। ২০১৫ সালে সরকার ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় ‘গ্লোবাল লার্নিং’ এর ওপর তিনি লন্ডন সফর করেন। দেশের জন্য বয়ে আনেন একের পর এক সম্মান। কিন্তু তার অর্জনে ঈর্ষায়িত হয়ে বাদ সাধেন প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষক ও আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান। সামাজিক সুনাম নষ্ট-সম্মানহানি-হয়রানি করে তারা জয়নবের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে করে চলেছে দুর্বিসহ ও ঝুঁকিপূর্ণ।
আরো জানা গেছে, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ‘গ্লোবাল লার্নিং’ এর ওপর স্কুলস অনলাইন পার্টনারশীপ ইংল্যান্ডের স্কটস প্রাইমারি স্কুলে ভিজিটকালীন সময়ে তিনি দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেখানে উপস্থাপন করেন। তাতে সন্তুষ্ট হন ইংল্যান্ডের হেভারিং মেয়র ব্রয়ান ইগলিং। ফলে মেয়র ভবনে গত ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই জয়নবকে রাণীর পোশাকে সজ্জ্বিত করে এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন মেয়র। যা ইংল্যান্ডের তিনটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়াও দেশের জাতীয় ও স্থানীয় কয়েকটি দৈনিকে তাকে নিয়ে ফিচার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ এমপি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ ছিদ্দিকির সাথে সাক্ষাত করানোর জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় শিক্ষক মিসেস জয়নবকে। সেখানে স্পিকারের চেয়ারে বসিয়ে সম্মান জানানো হয় তাঁকে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে ১৭টি দেশের ভাষার গান নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ভয়েজ’ প্রোগ্রামের তিনি একজন এ্যাম্বাসেডর। এ সম্মান অর্জনের পরও তাঁর বিদ্যালয়ের পক্ষে, উপজেলা শিক্ষা কমিটি কিংবা স্থানীয় শিক্ষক সমাজের পক্ষে কোন সংগঠন তাঁকে ন্যুনতম সম্মান জানায়নি। তবে জয়নবের লার্নিং পার্টনার ইংল্যান্ডের স্কটস প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক জ্যাকি বোর্ডম্যান বাংলাদেশ সফরে আসলে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন তাকে বাড়িতে গিয়ে সম্মান জানায়।
শিক্ষক জয়নব আরা বেগম সীমিত সুযোগ-সুবিধার বাধা ডিঙিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এগিয়েছেন অনেকটুকু পথ। বাংলাদেশ-কোরিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টের কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও কোরিয়ান গণিত ও বিজ্ঞান স্পেশালিস্ট টিম কর্তৃক তিনি পুরস্কৃত হন। দেশের ও বিদেশের এ দুই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশংসাপত্র ও উপঢৌকন দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দেশের ৬৪ জেলা থেকে মাত্র দুইজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষককে “টিচারস কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট”(টিকিউআই) প্রশিক্ষক নির্বাচিত করা হয়, তার মধ্যে মিসেস জয়নব একজন।
এতো অর্জনের পর ক্লাসে উপকরণ ব্যবহার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়া, স্কুল সজ্জিতকরণ, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণে সম্মানিত হওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে খোদ নিজ প্রতিষ্ঠানের দু’তিনজন শিক্ষকরা জয়নবের বিরুদ্ধে মাঠে নামে।
জানা গেছে, শিক্ষক বাতায়ন পোর্টালে সক্রিয় শিক্ষকের মধ্যে ২য় অবস্থানে থাকা জয়নবের স্কুলটি এখন ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যাওয়ার্ড’ পাওয়ার জন্য আবেদন করার জন্য নির্বাচিত স্কুল। কিন্তু এ আবেদনপত্রে ইতোপূর্বে স্কুলের এসএমসি সভাপতি স্বাক্ষর করে দিলেও প্রধান শিক্ষক অজ্ঞাত কারণে তাতে স্বাক্ষর করছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
জয়নব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বেগম ও সহকারী শিক্ষক নুরুল আজিম এলাকায় প্রচার করেন আমার এসব অর্জন শিক্ষামন্ত্রী এবং লন্ডনের মেয়রের সাথে নষ্টামী করে পেয়েছি। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘নৈতিকতা বিসর্জন দিলে সব অর্জন করা যায়।’ প্রধান শিক্ষকের করা এসব উক্তির কয়েক অডিও ক্লিপ থেকেও এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একজন সহকর্মীর এ্যাওয়ার্ড অর্জনকে এমন উপহাস ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাষায় প্রকাশভঙ্গিকে আলীকদমের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মানসিক দৈন্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
স্থানীয়রা মনে করেন,এই ব্যাপারে তদন্ত পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে শিক্ষক জয়নবের মতো শত মেধাবী জয়নবের দেশের জন্য কিছু অর্জন করার স্বপ্ন হারিয়ে যাবে, অন্যদিকে দেশে আধুনিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গতি হারাবে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, গত ২৮ মার্চ রাত নয়টার গাড়িতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের “প্রফেশনাল ডেভলাপমেন্ট কোর স্কিল” এ অংশগ্রহণ করতে ঢাকা যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম “সিরাজুল ইসলাম” ছদ্মনাম ধারণ করে কক্সবাজারের চকরিয়া থানা পুলিশকে অবহিত করে বলেন, জয়নব অন্যের সাথে পালিয়ে যাচ্ছেন। এসময় চকরিয়া থানার এস আই মাহির উদ্দিন খান উজ্জল তাকে আটক করে লাঞ্চিত করে, পরে ছেড়ে দেয় তাকে।
এছাড়া, নিজ স্কুলে ল্যাপটপ থাকার পরও ব্যবহার করতে না পারায় কিস্তির অর্থে ল্যাপটপ কিনে নেট ব্যবহার করে দেশকে ও নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি সম্মান এনে দেন জয়নব। তিনি আরো বলেন, মাল্টিমিড়িয়া ক্লাস করতে ল্যাপটপ ব্যবহার করেন বলে প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বলেন, “তুই যদি আর স্কুলে ল্যাপটপ ব্যবহার করিস তাহলে তোকে জুতা দিয়ে পিটাবো।”
উপায়ান্তর না দেখে জয়নব এ সব বিষয়ে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে। নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু তদন্ত কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে অভিযুক্তরা শিক্ষক জয়নব এবং তাঁর পক্ষের স্বাক্ষীদের নানা ধরণের হুমকী দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক হুমায়রা বেগমের কাছে সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এই ধরণের কোন কাজ করিনি, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা’।
আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি শিক্ষা কমিটির সভাপতি, উনার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অভিযোগ আছে, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন’।
বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
You must be logged in to post a comment.