সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / নারী ও শিশু / ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সম্মানে মা দিবস

ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সম্মানে মা দিবস

mother and child-1

মা দিবস একটি সম্মান প্রদর্শনমূলক অনুষ্ঠান। মায়ের সন্মানে মাতৃত্ব, মাতৃক ঋণপত্র এবং সমাজে মায়েদের প্রভাবের জন্য দিনটি উদযাপন করা হয়। মায়ের প্রতি সন্তানের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন দিনটির বিশিষ্টতা বহন করে।বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন দিনে এর আনুষ্ঠানিকতা পালন হতে দেখা যায়। সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসের যেকোনো দিনে মা দিবস পালিত হয়। এটি বাবা দিবস বা বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শনমূলক অনুষ্ঠানের অনুরূপ। মা দিবসের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস, গৌরবময় ঐতিহ্য আর সম্মান।

বিশ্বের প্রায় সব দেশে মা দিবস উদযাপন করতে দেখা যায়। দিনটি আনুষ্ঠানিকতা প্রাচীন উত্সবের সামান্য প্রামাণিক সাক্ষ্য বহন করে। যেমন, সিবেল গ্রিক ধর্মানুষ্ঠান, হিলারিয়ার রোমান উত্সব যা গ্রিকের সিবেল থেকে আসে, অথবা সিবেল এবং হিলারিয়া থেকে আসা খ্রিস্টান মাদারিং সানডে অনুষ্ঠানের অংশ স্বরূপ। বর্তমানে আধুনিক ছুটির দিন হলো একটি আমেরিকান উদ্ভাবন যা সরাসরি সেসব অনুষ্ঠান থেকে আসেনি। তা সত্ত্বেও, কিছু দেশে মা দিবস পুরোনো ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে পালন করা হয়।

একটি গোষ্ঠীর মতে এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে উত্সব পালন করা হতো। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণুবের সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ই মার্চ) থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে এই উত্সবটি পালিত হতো।

প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উত্সর্গিত আরও একটি ছুটির দিন ছিল। সেদিন মায়েদের বিশেষ উপহার দেয়া হতো। মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচার অনুষ্ঠান ছিল। সেসব অনুষ্ঠানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হতো। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী এটিকে বলা হয় লেতারে সানডে। লেন্টের সময়ে চতুর্থ রবিবারে পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও ‘প্রধান গির্জার’ সম্মানে। প্রথানুযায়ী দিনটিকে সূচিত করা হতো প্রতীকী উপহার দিয়ে। মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়া-মোছার মতো মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করতো।

জুলিয়া ওয়ার্ড হোই রচিত ‘মাদার্স ডে প্রক্লামেশন’ বা ‘মা দিবসের ঘোষণাপত্র’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবস পালনের গোড়ার দিকের প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে অন্যতম। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ১৮৭০ সালে রচিত হোই-এর মা দিবসের ঘোষণাপত্রটি ছিল একটি শান্তিকামী প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক স্তরে সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে নারীর একটি দায়িত্ব আছে, হোই-এর এই নারীবাদী বিশ্বাস ঘোষণাপত্রটির মধ্যে নিহিত ছিল।

পরবর্তী সময়ে ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং ‘মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার’ আর ‘মা দিবস’ এইসব শব্দবন্ধের বহুল প্রচার করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস দ্বারা দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে অনুমোদন করার জন্য বিল উত্থাপন করা হয়। সে বিল পাশের সময় আইনে এই প্রচারণার সাহায্য নেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এবং অন্যান্য নেতারা।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দিনে মা দিবস পালিত হয়। অল্প সংখ্যক দেশ মাদারিং সানডে-এর ব্রিটিশ প্রথা অনুযায়ী লেন্ট-এর চতুর্থ রবিবার পালন করে থাকে। তবে বেশিরভাগ দেশ মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালন করে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছুটির দিনটিকেই অনান্য দেশ এবং সংস্কৃতি একরূপে গ্রহণ করে সেহেতু মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারই অধিকাংশ দেশে মা দিবস হিসেবে খ্যাত। আমাদের দেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতা ও যথাযথ সম্মান মর্যাদার মধ্য দিয়ে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস পালন করা হয়।

যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডে বা গ্রিসের মন্দিরে যিশুর প্রাচীনপন্থী পুজার্চনার মতো মাতৃত্বের সম্মানে অনুষ্ঠানগুলো মেলাতে তারিখটি পাল্টে নেয়া হয়। ক্যাথলিক দেশগুলোতে ভার্জিন মেরি ডে বা মুসলিম দেশগুলোতে মা মরিয়মের জন্মদিনের মতো কিছু দেশে প্রধান ধর্ম অনুযায়ী তারিখটি পাল্টে দেয়া হয়। অন্য বহু দেশে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন তারিখ ব্যবহৃত হয়। যেমন- বলিভিয়া বেছে নিয়েছে এমন একটি তারিখ, যেদিন ওখানকার নারীরা একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

কিছু কিছু দেশে বহু আগে থেকেই মাতৃত্বের প্রতি উত্সর্গিত কয়েকটি অনুষ্ঠান ছিল। সেসব অনুষ্ঠানে মার্কিনরা মায়েদের কার্নেশন বা গোলাপী ফুল এবং অন্য উপহার দিতো।

কিছু দেশে মা দিবস পালন না করলে এটিকে প্রায় একটি অপরাধ গণ্য করা হয়। কিছু দেশে আবার মা দিবস একটি স্বল্প-পরিচিত উত্সব যা মূলত প্রবাসী মানুষেরা পালন করে থাকে বা বিদেশী সংস্কৃতি হিসাবে মিডিয়া সম্প্রচার করে থাকে। ক্যাথলিক ধর্মে, দিনটি বিশেষভাবে ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার পূজায় সমর্পিত। হিন্দু ধর্মে এটিকে বলে ‘মাতা তীর্থ অনুসি’ বা ‘একপক্ষব্যাপী মাতৃ তীর্থ যাত্রা’ এবং হিন্দু ধর্মালম্বী দেশগুলোতে, বিশেষ করে নেপালে এটি পালিত হয়। বর্তমানে আফ্রিকার বহু দেশ ব্রিটিশ প্রথানুযায়ী মা দিবস পালন করে।

১৯৯৭ সালে দরিদ্র মায়েদের সাহায্য করার জন্য, বিশেষ করে পশ্চিম চীনের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মায়েদের কথা মানুষকে মনে করানোর জন্য, এই দিনটিকে চালু করা হয়। গ্রীসে, যিশু কে মন্দিরে পেশ করার ইস্টার্ন অর্থডক্স ফিস্ট ডের সঙ্গেই পালন করা হয় মা দিবস। ২০ জুমাদা আল-সানি, মুহাম্মদ (স:) -এর মেয়ে ফাতিমা-র জন্মবার্ষিকীর দিন ইরানে পালন করা হয় মা দিবস। নারীবাদী আন্দোলনকে ইন্ধন যোগানো এবং ঐতিহ্য মাফিক আদর্শ পরিবারের মডেল তুলে ধরার জন্য ইরানীয় বিপ্লবের পর এটিকে এই দিনে পাল্টানো হয়। থাইল্যান্ডে মা দিবস পালিত হয় থাইল্যান্ডের রানীর জন্মদিনে। আয়ারল্যান্ড-এ , ইস্টের সানডে (২৭ মার্চ, ২০০৯)-র ঠিক তিন সপ্তাহ আগে, লেন্ট-এর চতুর্থ রবিবার মাদারিং সানডে পালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মে মাসের ২ তারিখে মা দিবস পালন করে।

প্রথমদিকে জাপানে শোয়া যুগে রানী কজুনের (রাজা আকিহিতো’র মা) জন্মদিনটিকেই মা দিবস হিসাবে পালন করা হতো। এখন এটি একটি জনপ্রিয় দিন। বিশেষত কার্নেশন আর গোলাপ উপহার হিসবে দেওয়া হয় এই দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে ১৯২২ সালে আলভারো ওব্রেগন সরকার মা দিবসের প্রচলন করেন এবং সেই বছরই এক্সেলসীয়র নামক সংবাদপত্রটি এই দিনটির সমর্থনে এক ব্যাপক প্রচার চালায়।

১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময়ে লাজারো কার্দেনাস সরকার মা দিবস কে একটি ‘দেশাত্মবোধক উত্সব’ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। নেপালে বৈশাখ (এপ্রিল) মাসে হয় ‘মাতা তীর্থে অনুসি’ বা ‘একপক্ষব্যাপী মাতৃ তীর্থ যাত্রা’। এই উত্সবটি পালিত হয় অমাবস্যার সময় যার জন্য এটির নাম ‘মাতা তীর্থে অনুসি’। ‘মাতা’ মানে মা, ‘তীর্থ’ মানে তীর্থযাত্রা। উত্সবটিতে মৃত মায়েদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় এবং জীবিত মায়েদের উপহার দেওয়া ও সম্মান জানানো হয়। কাঠমাণ্ডু উপত্যকার পূর্বদিকে অবস্থিত মাতা তীর্থে যাওয়া এই উত্সবের একটি অঙ্গ। ভিয়েতনামে মা দিবসকে বলা হয় লে ভূ-লান এবং চান্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী সপ্তম মাসের পঞ্চদশ (পনেরো) দিনে এটি পালিত হয়। যাদের মায়েরা জীবিত তারা ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানায় আর যাদের মায়েরা পরলোক গমন করেছেন তারা প্রার্থনা করে মৃত মায়েদের আত্মার শান্তি কামনা করে।

মা দিবস উপলক্ষ্যে ছুটির দিনটি ধীরে ধীরে বেশ বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে। দিনটির প্রনেতা আনা জার্ভিস এটিকে একটি ‘হলমার্ক হলিডে’ অর্থাত্ যে দিনটির বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয়তা অভিভূত করার মতো একটি দিন হিসাবে বিবেচিত করেন। অবশ্য পরবর্তীতে নিজের প্রবর্তিত ছুটির দিনটির নিজেই বিরোধিতা করা শুরু করেন।

চীনের মা দিবস ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কার্নেশন সেখানে জনপ্রিয়তম উপহার এবং বেশি বিক্রিত ফুল। মা দিবস এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফলতম পর্ব। ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোশিয়েশনের মতে, রেস্টুরেন্টে ডিনার করার অন্যতম জনপ্রিয় দিন হল মা দিবস। উদাহরণ স্বরূপ দেখা যেতে পারে যে, IBIS world নামে একটি বানিজ্যিক পত্রিকার প্রকাশকের মতে, আমেরিকানরা আনুমানিক ২০৬ বিলিয়ন ডলার ফুলের ওপর, ১.৫৩ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন বিলাসী উপহারের জন্য, স্পা ট্রিটমেন্ট, গ্রিটিংস কার্ড এবং অন্যান্য মিলে ৬৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করে।

সূত্র:banglamail24.com

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

ঈদগাঁওতে উৎসবমুখর ভোটগ্রহণ : নারী ভোটারদের উপস্থিতি : অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি

  এম আবু হেনা সাগর; ঈদগাঁও :কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ, ইসলামপুর ও ঈদগাঁও ইউনিয়নে ব্যাপক ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/