খুব ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রশ্ন, মা আমি কোথা থেকে এসেছি। মা হেসে জবাব দেয়, ইচ্ছে হয়ে বুকের মধ্যে ছিলি। সেই শুরু। মায়ের সঙ্গে সন্তানের কথোপকথন যেন তারপর এক বহতা নদী। যত দিন গড়ায় বদলে যায় সে কথোপকথোনের রঙ। কখনো ভয় তো কখনো আদর, কখনো অভিযোগ তো কখনো অভিমানে মাখা সেই কথারা চিরকাল থেকে যায় শৈশব-কৈশোরের গন্ধ মেখে। সময় পেরিয়ে যায়, স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে যায় বয়স। কিন্তু সেই কথাগুলো চিরকাল থেকে যায় মনের গোপন কুঠুরিতে।
মায়ের জন্য তুলে রাখা বিশেষ একটা দিনে তা ফিরে দেখতে মন্দ কী। কার না ভালো লাগে মায়ের সেই তথাকথিত হুমকি মনে করতে, ‘দিনরাত টো টো কোম্পানি, একটু বইপত্তর নিয়ে তো বসতে পারিস’। পড়াশোনায় যে যেমনই হোক না কেন, এমন কথা মায়ের থেকে শোনেনি এমন সন্তান খুব কমই আছে। কিংবা ছুটির দুপুরে এরকম কথা শোনার অভিজ্ঞতা কার না হয়েছে যে মা বলছেন, ‘কাজের কথা বললেই চোখে ঘুম এদিকে বন্ধুরা এলেই সব হাওয়া’।
তবে ছোটবেলার সবথেকে মোক্ষম হুমকি বোধহয় ছিল এটাই ‘তোর বাবা আসুক, তারপর দেখবি’। কী হবে কেউ জানে না, তবে এ হুমকিতে বুক কাঁপেনি এমন সন্তানের খোঁজ মেলা দুষ্কর। বয়স যত পাল্টেছে, বদলে গিয়েছে এ কথার ধরন। কখনো তা এরকম- ‘আগে চাকরিবাকরির বন্দোবস্ত হোক, পরে আরাম করবি’। কিংবা আরো পরে, ‘অমুখের ছেলে তো মাসে মাসে টাকা পাঠায়, কই তুই তো পাঠাস না। সব কী উড়িয়ে ফেলছিস?’। কিংবা ‘এখন না জমাতে পারলে পরে ভুগবি’।
ব্যস্ততা, কাজের চাপ কিংবা অন্য কারণে এ কথা শুনে অনেক সময়ই কেউ রেগে গিয়েছেন। কিন্তু মায়ের জন্য একটা দিনে মায়ের বলা কথা মনে করতে গিয়ে অনেকেরই মনে ফিরে ফিরে আসছে এ কথাই। সন্তানের রাগ-অভিমানের উত্তরে সব মায়েরা একটা কথাই বলতেন, ‘নিজে বাবা-মা হলে বুঝবি কেন বলি’। সময়ে পেরিয়ে এখন হয়তো অনেক সন্তানই বাবা-মা। হাজার লোকের মাঝে নিজের সন্তানের প্রশংসা করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে, আচ্ছা মা কী কখনো কখনো সকলের সামনে এমন প্রশংসা করেছিল? হ্যাঁ, এই একটা কথা হয়তো সন্তানের সামনে মা কখনো বলেননি। কিন্তু বলেছেন। পরিচিত বৃত্তে কান পাতলেই শোনা যায় সকল মায়ের একই কন্ঠস্বর- ‘আমার ছেলে কিন্তু আর পাঁচজনের মতো নয়’। প্রতিটি সন্তান জানে এ কথা বলার জন্য একজীবনে একজনই থাকেন, আর কেউ নয়।
এ কারণেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় এবং মধুরতম শব্দটি ‘মা’। মা শুধু প্রিয় শব্দই নয়, প্রিয় বচন, প্রিয় অনুভূতি, প্রিয় ব্যক্তি, প্রিয় দেখাশুনা, প্রিয় রান্না এবং প্রিয় আদর। যতগুলো প্রিয় আছে তার সব প্রিয়ই শুধুমাত্র মাকে কেন্দ্র করেই।
জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে। তাই তাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য শুধু একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারটিকে ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১৪ সালের ৮ মে থেকে।
কারো কারো প্রশ্ন ‘মা’ কে ভালোবাসা দেখানোর জন্য ঘটা করে ‘মা দিবস’ পালন করার কী তেমন কোনো প্রয়োজন আছে? কেউ মনে করেন প্রয়োজন নেই, আবার অনেকের মতে উপহার দিয়ে একটি বিশেষ দিনে মা কে ভালোবাসা দেখানোর পরিকল্পনাটা খারাপ না।
অবশ্য এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয় কারণ অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তার সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী। সবাই চায় এই দিনে মাকে খুশি করতে। মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে, মাকে সুন্দর সুন্দর জিনিস বানিয়ে উপহার দিতে আরো অনেক কিছু।
তবে যতদিন ‘মা বেচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস’ হিসেবে। কবি নজরুলের ভাষায়- ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/ একটি কথায় এত সুধা নাই/ মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/ আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই।’
সূত্র:মনিরুল হক ফিরোজ/risingbd.com
You must be logged in to post a comment.