জাপানের ব্যস্ততম শহর ছিল নাগাসাকি। শহর ঘুমিয়েছিল তার বসবাসকারীদের বুকে নিয়ে। শহরের বুকে মাথা গোজে মানুষজন ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তারা জানত না সেই ঘুমই হবে জীবনের শেষ ঘুম। ওই ঘুম থেকেই চির ঘুমের দেশে হারিয়ে যায় নাগাসাকির হাজার হাজার মানুষ। ১৯৪৫ সালের এই দিনে জাপানের নাগাসাকিতে আমেরিকা নিক্ষেপ করেছিল পারমানবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় ফেলা হয় প্রথম পারমানবিক বোমা ‘লিটল বয়’। আর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ফেলা হয় দ্বিতীয় বোমা। স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪৭মিনিটে গভীর ঘুমে বিভোর নাগাসাকিবাসীর ওপর ফেলা হয় ফ্যাটম্যান। নিমিষেই নাগাসাকি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। প্রায় ৭০ (মতপার্থক্যও) হাজার নিহত হয় এই বোমায়। আহত হয় প্রায় লাখ খানেকের মতো। বোমা বিস্ফোরণের সাত দশক পরও তেজষ্ক্রিয়াতায় আজো নাগাসাকিতে জন্ম নিচ্ছে শারীরিক অসুস্থতা সঙ্গে নিয়ে।
৭১ বছর পরও জাপানিরা ভুলতে পারেনি সেই নির্মমতার কথা।প্রতিবছর ৯ আগস্ট ঘুরে ঘুরে আসে। নাগাসাকি শহরের মানুষ উপসনালয়ে উপস্থিত হয়, ফুল দিয়ে মোমবাতি জ্বেলে স্মরণ করে নিহতদের। স্মৃতিস্তম্ভগুলো ফুলে ফুলে ভরে যায়। নিহতদের প্রতি জানানো হয় শ্রদ্ধা। পঙ্গুত্ব বরণকারীদের প্রতি জানানো হয় গভীর সমবেদনা। আর সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি প্রিয় মানুষরা বিভিন্নভাবে স্মরণ করে দিনটিকে।
জাপানি সরকার ও নাগাসাকির মানুষ সেই ধকল প্রায় কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো। তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাবে এখনো দেখা দিচ্ছে নানা রোগ।
পারমানবিক বোমা মানবজাতির জন্য ভয়াবহ অভিশাপ। বিশ্ববাসী হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বুঝেছিল পারমানবিক বোমার ভয়াবহতা। সেই থেকে পারমানবিক বোমার বিরুদ্ধে শান্তি প্রিয় বিশ্ববাসী বরাবরই সচেতন ছিল, প্রতিবাদ করেছে। আর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তো পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তিও (এনপিটি) বিদ্যমান। তারপরও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হয়নি পারমানবিক বোমা বানানোর পরিকল্পনা। পারমানবিক বোমা বানানোর চেষ্টাকারী দেশ ও যেসব দেশে ইতোমধ্যে বোমা আছে সবার প্রতিই শান্তি প্রিয় মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রদিবাদ শুরু হয়। সেই প্রতিবাদে শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পারমানবিক শক্তির ব্যবহরা পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উদারহণ দেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে চলছে হানাহানি, খুনখারাবি। বিশ্ব রাজানীতির মূলে থাকা নির্ভর করে পারমানবিক বোমার অধিকারী হওয়া না হওয়ার ওপর। আবার পারমানবিক বোমার অধিকারী হওয়ার পথে বা চেষ্টা চালানো হচ্ছে এই অভিযোগেও তো সব সময় মৌন যুদ্ধ লেগেই আছে। শান্তিপ্রিয় মানুষের ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’ বার্তা খুব কমই পৌঁছায় বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়কদের কানে।খোদ জাপানেই কি ব্যতিক্রম হচ্ছে না? জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনেজা আবের প্রশাসনের সামরিক ব্যয় দেখলেই তাদের মনোভাব বুঝা যায়। দেশটির নাগরিকরা ইতোমধ্যে এর প্রতিবাদও করেছে।
সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে নাগাসাকি নগরী। কিন্তু এই পতন-উত্থানের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসী দেখেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, দেখেছে পারমানবিক বোমার ভয়বহতা ও তেজষ্ক্রিয়তা। বর্তমান বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এখন। সর্বত্র মানুষের আহজারি আর আর্তনাদ। পৃথিবীর কোথাও যেন নিরাপদ না মানুষ। এক অনিশ্চিত ঘোর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত পৃথিবী। এই মুহূর্তে মৈত্রীভাবাপন্ন আর পারস্পারিক সহমর্মিতাই পারে সংঘবদ্ধভাবে নিরাপদে বেঁচে থাকায় সাহায্য করতে। শান্তির জন্য এগিয়ে আসতে হবে পৃথিবীর সব মানুষকে। মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যুদ্ধ না শান্তির পক্ষে থাকবে।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। পরিশেষে নাগাসাকির নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। আহত এবং স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণকারী ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি সমবেদনা।
সূত্র:রুহুল আমিন, risingbd.com, ডেস্ক।
You must be logged in to post a comment.