হুমায়ুন কবির জুশান; উখিয়া :
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সীমাহীন নির্যাতনের একটি বছর পার হতে চলেছে। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখের চেয়েও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও অনেকেই স্বামী হারা হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ ধর্ষণ ও গণহত্যা চালিয়ে রাখাইনে নিপীড়নের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি সমালোচনায় পড়েছেন। বিশ্ব নেতারা তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। অনিশ্চিয়তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের একটি বছর পার হতে চলেছে। ক্যাম্পে অবস্থানরত মুরব্বিরা গত বছরের ২৫ আগস্টের কালো অধ্যায়ের দুর্বিসহ দিনকে স্মরণ করে কোরআন তেলোয়াতের মাধ্যমে বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকছেন।
কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি মোরশেদ আলম বলেন, আল্লাহ পাক মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্যে। আগস্ট মাস রোহিঙ্গাদের জন্য বেদনার মাস। ক্যাম্পের প্রতিটি ঘরে ঘরে কোরআন তেলোয়াত চলছে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি আমরা। স্বজন হারা রোহিঙ্গারা বুক ফাটা আর্থনাদ করছে।
সরেজমিন তাদের অবস্থার খোঁজ খবর নিতে গতকাল কুতুপালং ক্যাম্পের এফ ব্লকের বাসিন্দা মিয়ানমারের বুচিদং এলাকার ৯৪ বছরের বৃদ্ধ নাজির হোসেন বলেন, হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। অতীতে মিয়ানমার পার্লামেন্টে আমাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৮২ সালে আমাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় সামরিক জান্তা সরকার। আমরা যারা আরাকানের আদি বাসিন্দা, তারা হলাম বহিরাগত। আর রাখাইন বৌদ্ধ যারা অন্য দেশ থেকে এসেছে, তারা হয়েছে সে দেশের নাগরিক। সত্যিই, দুর্ভাগা জাতি রোহিঙ্গা।
চরম হতাশা প্রকাশ করেন আরেক রোহিঙ্গা কোয়াংচিপ্রাং এলাকার ৬৫ বছরের আব্দুল ফত্তাহ। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালেও আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। দুই যুগের বেশি সময় তাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে দেয়নি মিয়ানমার সরকার। এর ওপর নতুন নতুন সংকট তৈরি করে ফের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাশূন্য করতে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করছে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী। মিয়ানমার সরকারের ওপর আমাদের আর কোনো আস্থা নেই। একই এলাকার নুর আলম বলেন, নাগরিক অধিকারসহ পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে রোহিঙ্গারা আর স্বদেশে ফিরে যাবে না। ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্বদেশ ফেরা নিয়ে রয়েছেন অনিশ্চিয়তায়। তাদের মনে শঙ্কা-ভয়, আদৌ কি ফিরে যেতে পারবেন নিজ দেশে? ফিরতে পারলেও সহসা যে হচ্ছে না, সেটাও তাদের বদ্ধমূল ধারণা। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মনে করছেন, অতীতের মতো তাদের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকতে হবে। তাই এদের অনেকেই ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি কিছু একটা করে ভালোভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
মিয়ানমারের মংডু মাইজপাড়া থেকে ১১ মাস আগে পালিয়ে এসে বালুখালী ক্যাম্পে ডি ব্লকে আশ্রয় নিয়েছেন মুফিজ উদ্দিনের (৪৫) আট সদস্যের পরিবার। তিনি বলেন, ডাব্লিউ এফপি আমাদের চাউল, ডাল, তেল দিচ্ছে। কিন্তু মাছ তরিতরকারি তো দিচ্ছে না। তাই ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয়দের বাড়ি-ঘরে চাষাবাদের কাজ করছি। অথচ আমি জীবনেও এসব কাজ করিনি। মিয়ানমারে আমার বড় দোকান ছিল। আমি সেখানে ব্যবসা করে জীবন কাটিয়েছি। এখানে স্ত্রী- সন্তানদের মুখের দিকে থাকিয়ে বাড়িঘরে কাজ করছি। আর উপার্জিত টাকায় মাছ, মাংস ও তরিতরকারি কিনে সংসার চালায়। এখানকার মানুষজনও আমাদের প্রতি খুবই সদয় ব্যবহার করেন। গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় তারা অনেকটা হতভম্ব হলেও নিরুপায় রোহিঙ্গারা তা ভুলে গিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনছেন।
You must be logged in to post a comment.