সাম্প্রতিক....
Home / প্রচ্ছদ / ভ্রমণ ও পর্যটন / সহস্র সিঁড়ির পর চন্দ্রনাথ ধাম

সহস্র সিঁড়ির পর চন্দ্রনাথ ধাম

মেঘে ঢাকা চন্দ্রনাথ ধাম

দশ-বারো বছর বা তারও আগে টিভিতে একটি নাটক প্রচারিত হয়েছিল। নাটকের নাম মনে নেই তবে পরিচালনা করেছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নাটকটির মাধ্যমে জেনেছিলাম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধামের কথা। দক্ষিণ থেকে উপকূলীয় এলাকা ধরে এগিয়ে আসা পর্বত রেঞ্জের সর্বোচ্চ চূড়ায় এর অবস্থান। রয়েছে সহস্র সিঁড়ি আর সেই সিঁড়িই হচ্ছে ধামে আরোহণের একমাত্র পথ।

পাহাড়ের শরীর পেঁচিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে বহু পুরনো সিঁড়ি। বিষয়টি এতটাই মনে ধরেছিল যে, চট্টগ্রামের ওদিকটায় যাওয়া আসার পথে সীতাকুণ্ড পৌঁছার আগেই সজাগ হয়ে যেতাম। মহাসড়ক থেকে ঐ দূর পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যেত ছোট্ট একটি রঙ্গিন ঘর। ট্রেন অথবা বাসের জানালা দিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় কেবলই তাকিয়ে থাকতাম। আবার কখনও মেঘের দাপটে দেখতে না পেয়ে আশাহত হতাম। কারণ চূড়াটি প্রায় সময়ই মেঘে ঢাকা থাকে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর চলমান বাহণ থেকে দৃষ্টি যতটা পারা যায় সরু করে নিক্ষেপ করতাম পাহাড়ের ওপর।

না, ব্যর্থই হয়েছি বারবার, একবারও চোখে পড়েনি বহু পুরনো সেই সিঁড়িগুলি। মনের ভেতর বেদনা অনুভব হতো, কবে ঐ সিঁড়িতে একটি একটি করে পা রেখে উঠে যাব উপরে, অনেক উপরে! পথিমধ্যে হওয়ায় চাইলেও হুট করে নেমে পড়া যায় না। কোনোবার ভাবতাম এবার যাওয়ার পথে তো পরের বার ফেরার পথে, প্রকৃত পক্ষে একবারও নামা হয়ে ওঠেনি।

২০১৩ সালের ডিসেম্বর অর্থাৎ ১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগের কথা, পার্বত্য এলাকার প্রত্যন্ত এক বসতিতে এক টানা কয়েক দিন কাটানোর পর ঢাকা ফিরছি। এদিকে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে ৪-৫ জন বন্ধু। উদ্দেশ্য রেলের ট্র্যাক ধরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে আসা। চট্টগ্রাম আসার আগেই সংবাদ পাই এবং তাদের সাথে মিলিত হয়ে উদ্দেশ্য পূরণে যোগদান করি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন নাজুক। চলন্ত গাড়িতে বোমা মেরে অগ্নিসংযোগ এবং রেল লাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলা যেন দৈনন্দিন বিষয়। পত্রিকা খুললেই কোথাও না কোথাও এমন দু-একটি অঘটনের সংবাদ পেতাম। সেদিক থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং মীরেরসরাই এলাকা ছিল প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। ইচ্ছা ছিল চন্দ্রনাথ ধামটা এবার দেখবই। কিন্তু সীতাকুণ্ড এলাকায় প্রবেশের পর এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, পাঁচ কিলোমিটারের মত হাঁটতেই স্থানীয়দের দ্বারা চেকিং এবং হয়রানির শিকার হতে হয়েছে কমপক্ষে দশ বার। তাদের আর বুঝাতে পারি না যে, আমরা ট্রাভেলার। এক পর্যায়ে তাদের বাধা ও দুর্ব্যবহারের কারণে রেললাইন ছেড়ে নামতে হলো সড়কে। ফলে স্পৃহাটাও যেন  মরে গেল। যাইহোক, সে অভিজ্ঞতা অন্য কোনো দিন ভাগাভাগি করা যাবে। সেবারও দেখা হলো না সহস্র সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে চন্দ্রনাথ ধাম!

পাথরের ফাঁক দিয়ে সিঁড়ি

দীর্ঘ দিন পর মনের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো গত রোজার ঈদে। জুলাইয়ের এক তারিখ ভোরে তিনজন রওনা হলাম সায়দাবাদ থেকে। চমৎকার একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, যা সম্পন্ন করতে ৫-৬ দিন লেগে যাওয়ার কথা। প্রথম দুইদিন কয়েকটি জায়গা দেখে আশ্রয় নিলাম মীরেরসরাই এক জঙ্গল বাড়িতে। যথারীতি পরের দিন সকালে উঠেই রেল লাইন ধরে এগিয়ে চললাম রড়তাকিয়া স্টেশনের দিকে। মাঝাড়ি গতির বৃষ্টি সেই আগের দিন থেকেই চলমান। প্রত্যেকের মাথার উপর একটি করে ছাতা মেলানো। মৌসুম বদলের সাথে সাথে প্রকৃতি বোধহয় তার নিজস্ব গন্ধেও এক ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। রেল লাইন বেয়ে গড়িয়ে পরছে জং ধরা খয়েরী জল, তার নিচে থাকা পাথরগুলো রাঙিয়ে দিচ্ছে। দুই পাশে হালকা জঙ্গল এবং ধান ক্ষেত থেকে আসা অমল সুবাস। সব মিলিয়ে অচেনা এক গন্ধ বয়ে যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। আকাশজুড়ে মেঘেদের চঞ্চল চলাফেরা, তার ফাঁক থেকেই গুড়ুম গুড়ুম ডাকাডাকি। বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেতের পরেই পর্বত সারি। রেল লাইনের সাথে সাথে যেন পাহাড় সারিও এগিয়ে চলছে, এ যাত্রা কোনো দিনও শেষ হবার নয়! বড়তাকিয়া থেকে মিনিবাসে রওনা হলাম সীতাকুণ্ডের দিকে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। রোজার দিন, বাজারের সমস্ত রেস্টুরেন্ট বন্ধ। অনেক খোঁজাখুজির পর একটি মাত্র মিললো। কিন্তু তাতে আমাদের তাজ্জব বনে যাওয়ার উপক্রম- যেখানে প্রকাশ্যে পান চাবানো পর্যন্ত অন্যায় তুল্য সেখানে রেস্টুরেন্ট খোলা! এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিল সীতাকুণ্ডে রোজাদার ছাড়া আর কেউ বাস করে না। সাইনবোর্ডটার দিকে চোখ গেলে বুঝতে পারলাম তার প্রকৃত মাজেজা। হিন্দু মালিকের রেস্টুরেন্ট কিন্তু কাস্টমার মুসলমানও কম নয়।

 খাওয়ার পর্ব সেরে এবার স্থানীয় দু-একজনের সাথে কথা বলে ধামে যাওয়ার পথটা জেনে নিতে হলো। একটি অটোরিকশা নিয়ে এগিয়ে চললাম। পথিমধ্যে অল্প কিছু দূর ফাঁকে ফাঁকে মন্দির, আশ্রম এবং শশ্মান ইত্যাদি চোখে পড়ল। বাজারে বোঝা না গেলেও সম্পূর্ণ ভেতরটা সনাতন হিন্দুদের অধিক্য। এরই মধ্যে পাহাড়টাও নিকটবর্তী হয়ে গেল। অটো নামিয়ে দিল তার শেষ গন্তব্যে। এরপর থেকে কেবল পদব্রজে উপরে উঠে যাওয়া।

একটি স্থায়ী তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে খানিক উপরে মন্দির প্রাঙ্গন। উঠতে হবে অনেকটা, তাই মন্দিরের ছোট্ট দোকানে চা-পান করে ব্যাগে পুরে নিলাম কিছু শুকনা খাবার ও পানির বোতল। একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে এগুতে থাকলাম। পাহাড়ের গায়ে লিকলিকে সরু সিঁড়ি, এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির কারণে ধসে পরেছে। সিঁড়িগুলো যারপর নাই অস্বস্তিকর এবং কষ্টদায়ক! অবৈজ্ঞানিক পন্থায় নির্মিত, স্বচ্ছন্দে আরোহণ করার মত নয়। সনাতন ধর্মের অনেককেই পেলাম, হয় উঠছে নয়তো নেমে আসছে। কৌতূহল সামাল দিতে না পেরে দু-একজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, ধামে দর্শন দিতে পেরে তারা কতটা ধন্য বা স্বার্থক। পঞ্চাশোর্ধ এক নারী সমস্তটা পথ দুই ছেলের কাঁধে ভর করে উঠেছেন। অনুভূতির কথা জানতে চাইলে বললেন, জীবনে একটা স্বপ্ন ছিল, আজ তা পূর্ণ হলো!

 

হাতে সময় ছিল অগাধ তাই কয়েক দফা বিশ্রাম করে উপস্থিত হলাম অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গাটিতে। এরপর বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট উঠলেই চন্দ্রনাথ ধামের মূল মন্দির। এরই মধ্যে মন্দির ঘন মেঘে ঢেকে গেছে। কমলা রং করা মন্দিরের উপর বর্ষণ হচ্ছে যেন জগতের সমস্ত বৃষ্টি আর মেঘ। পাহাড়-পর্বতে সাধারণ ট্রেইল ধরে আরোহণ করা আর সিঁড়ি বেয়ে আরোহণের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দ্বিতীয়টা সত্যিই কষ্টকর, তাও যদি এমন বিশ্রী গঠনের সিঁড়ি হয়ে থাকে। মেঘের স্তর কেটে শেষ পর্যন্ত ধামে আরোহণ করতে সমর্থ হলাম। কোনো মানুষ নেই, কেবল আমরাই তিনজন। বৃষ্টি এবং মেঘের সাথে ঝড়ো বাতাস বইছে। খানিক আগেও নিচের অনুচ্চ পাহাড় ও সীতাকুণ্ড বাজারের দালান-কোঠা দৃশ্যমান ছিল। এখন শুধু মেঘ আর মেঘ। শীতও বেড়ে চললো। আমাদের দেখে পেছনের ঘর থেকে মৃদু পায়ে হেঁটে এলেন কমলা রঙের কাপড় জড়ানো ধামের পুরোহিত মহাশয়।

উপর থেকে দেখা বঙ্গোপসাগর

দু-চার কথার পর মূল মন্দির কক্ষের তালা খুলে আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন। প্রসাদস্বরূপ সকলের হতে তুলে দিলেন বাতাসা। প্রায় দুই ঘণ্টার আলাপ আলোচনায় জানা গেল, ধামকে ঘিরে তাদের বিশ্বাসের কথা। চন্দ্রনাথ ধাম মূলত একটি শিব মন্দির। ভেতরে রয়েছে একটি কালো পাথরের শিব লিঙ্গ। এটি নাকি কেউ তৈরি করেননি অর্থাৎ কারও হাতের তৈরি নয় বরং সয়ম্ভূ। চার কালের প্রথম কাল সত্য যুগে নিজে নিজেই আবির্ভূত হওয়া। প্রতি বছর মার্চ বা এপ্রিলে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূজায় দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ তীর্থযাত্রী কেবল মাত্র এই শিব লিঙ্গে পূজা দিতে এখানে আসে। ধামের উচ্চতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলে ১৮০০ ফুট তো কেউ বলে ২০০০ ফুট। আসলে এর উচ্চতা ১১-১২০০ ফুটের মধ্যে। একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো, ধাম থেকে বঙ্গোপসাগর স্পষ্ট দেখা যায়। আর ওঠা-নামার পথে খুব সহজেই বানরের দেখা মেলে।

সূত্র:ফেরদৌস জামান/risingbd.com,ডেস্ক।

Share

Leave a Reply

Advertisement

x

Check Also

মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স এর সৌন্দর্য হাতছানি দিচ্ছে, #https://coxview.com/tourism-lama-mirinja-rafiq-20-09-2023-00/

মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স এর সৌন্দর্য হাতছানি দিচ্ছে

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম; লামা-আলীকদম :প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান গুলোর অন্যতম বান্দরবানের লামার ‘মিরিঞ্জা ...

https://coxview.com/coxview-com-footar-14-12-2023/